বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ১২, ২০২৪
অর্থনীতিলীড নিউজ

১৫ বছরে যে দুর্নীতি হয়েছে, তা অকল্পনীয় : অর্থ উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গত ১৫ বছরে বিশেষ করে অর্থনৈতিক খাতে যে ধরনের দুর্নীতি হয়েছে, তা অকল্পনীয় এবং সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

শনিবার (৩০ নভেম্বর) সোনারগাঁও হোটেলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘প্রাইভেট সেক্টর আউটলুক; প্রত্যাশা ও অগ্রাধিকার’ শীর্ষক বাণিজ্য সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে বাণিজ্য উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিএবির সভাপতি আব্দুল হাই সরকার, বিটিএমএ শওকত আজিজ রাসেল, ফিকির সভাপতি জাভেদ আখতার, এবিবির সভাপতি সেলিম আর এফ হোসেন, প্রাণ আরএফএর গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী ও ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির-এ বাণিজ্য সম্মেলনে প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নেবেন।

প্রধান অতিথি অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ব্যাংক থেকে ডিপোজিট নিয়ে চলে গেছে, এর দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে বিরল, তবে অন্তর্বর্তী সরকার সেটার উত্তরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সময় লাগতে পারে। মূল্যস্ফীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ, তবে রিজার্ভ স্থিতিশীলতা ও সুদের হার সন্তোষজনক পর্যায়ের মাধ্যমে এ অবস্থার উত্তরণ হবে।

তিনি জানান, এনবিআর নিয়ে বেসরকারি খাতের অভিযোগ রয়েছে। সব আইনই ব্যবসা সহায়ক হওয়া প্রয়োজন বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।

উপদেষ্টা জানান, এনবিআরের কার্যক্রমে অটোমেশন করার প্রক্রিয়া চলছে এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে ট্যাক্স পলিসি ও ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে আলাদা করার প্রক্রিয়া চলছে। তবে বেসরকারি খাতে বিশেষ করে এসএমই খাতে ঋণ সহায়তা যেন কোনোভাবেই কমে না যায় সেটার প্রতি লক্ষ্য রাখাতে হবে বলে অভিমত জানান।

বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে সরকারের সাথে বেসরকারি খাতের সমন্বয় আবশ্যক এবং বিদ্যমান অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করেন।

একই পণ্যের একাধিক বাণিজ্য সংগঠন আছে। এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী সময়ে ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের বাণিজ্য সম্প্রসারণে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন।

তবে কবে নাগাদ গ্রাজুয়েশন করা যৌক্তিক হবে সে বিষয়ে আরও ডায়লাগ করার ওপর তিনি জেরারোপ করেন, কেননা এলডিসি পরবর্তী সময়ে আমরা বেশকিছু অগ্রাধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে, এর পাশাপাশি সহায়ক নীতিমালার কোনো বিকল্প নেই বলে মত দেন।

তিনি বলেন, নিজেদের বাণিজ্যের উদারীকরণের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যের সাবসেক্টরগুলোর জন্য সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

এছাড়াও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে সরকারি ব্যয় বাড়াবে, তাই আমাদের কর আহরণ বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করতে হবে, এর মাধ্যমে জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন সম্ভব হবে।

বাণিজ্য সম্মেলনের স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা চেম্বারের সভাপতি আশরাফ আহমেদ বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বছরের শুরুতেই নীতি সুদহার এবং সুদহার ক্রমান্বয়ে হ্রাসকরণের পাশাপাশি সরকারি ব্যয় হ্রাস, বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, পণ্য ব্যবস্থাপনায় চাঁদাবাজি রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

মুদ্রাবাজারে স্থিতিশীলতা আনায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মার্কিন ডলারে বিনিময়হার বাজারে বিদ্যমান হারের কাছাকাছি রাখার ওপর জোরারোপ করে তিনি বলেন, ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণের মাধ্যমে বিশেষকরে এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যবসা প্রক্রিয়া সহজতরের লক্ষ্যে সামগ্রিক শুল্ক ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি ব্যবসা নিবন্ধন ও নবায়ন প্রক্রিয়ায় অটোমেশনের দাবি জানান তিনি।

ঢাকা চেম্বার সভাপতি বলেন, পণ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর জোরারোপ করেন আশরাফ আহমেদ।

‘বৈশ্বিক বাণিজ্যের সাথে নিজেদের সম্পৃক্তকরণের জন্য এখনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আমাদের পক্ষে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। ’

আব্দুল মোক্তাদির বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করলেও কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর সুফল আসবে।

তিনি বলেন, শিল্প-কারখানায় অস্থিরতা কোনোভাবেই কাম্য নয়, তাই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সুনির্দিষ্ট সময়সীমাসহ রোডম্যাপ থাকতে হবে।

তিনি জানান, বিভিন্ন পণ্যের উচ্চ আমদানি শুল্ক হারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি এবং ছোট ব্যবসায়ীরা কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। আমাদের বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, তাই কয়লার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জোর দিলেই শিল্পখাতে আরও বেশি হারে গ্যাস সরবরাহ সম্ভব হবে।

আহসান খান চৌধুরী বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন হলে ব্যবসার উন্নয়ন আসবে।

তিনি উল্লেখ করেন, ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনের নিরিখে এলসি খুলতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান দুটোই ব্যাহত হবে। নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিখাতের উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি তিনি পার্শিয়াল বন্ড ইস্যুর প্রস্তাব করেন।

এছাড়াও তিনি বিদ্যমান পরিস্থিতি বিবেচনায় ঋণের সুদের হার হ্রাস প্রদান করা প্রয়োজন বলে মতপ্রকাশ করেন।

সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন সরকারের পক্ষ হতে এখনও কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়নি, তবে দ্রুতই এটি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। তবে অর্থনৈতিক খাতে সরকার বেশ ভালো করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র সংকোচনমূলক মুদ্রানীতিই যথেষ্ট নয়, বরং পণ্যের সাপ্লাইচেইনে চাঁদাবাজি বন্ধসহ বাজার ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে। আর্থিকখাতের মামলাজট নিরসনে তিনি আরও বেশি হারে আদালত ও বিচারপতি নিয়োগের আহ্বান জানান।

জাভেদ আখতার বলেন, বৈদেশিক বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা, ধারাবাহিকতা ও সক্ষমতা একান্ত অপরিহার্য। এলডিসি উত্তরণের বিষয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় তিনি নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানান।

আব্দুল হাই সরকার বলেন, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোনগুলোতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নের পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি উল্লেখ, দেশকে স্বাভাবিক পর্যায়ের নিয়ে আসতে সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

তিনি জানান, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত ছাড়া শিল্প উন্নয়ন সম্ভব নয়, এ অবস্থার উন্নয়ন জরুরি।

শওকত আজিজ রাসেল বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আমরা বেশ পিছিয়ে রয়েছি এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসে বিশেষ করে দুর্নীতি কমানোর ওপর তিনি জোরারোপ করেন।

তিনি আরও বলেন, অনুসন্ধানের মাধ্যমে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন না করায় আমাদের উচ্চ মূল্যের গ্যাস দিয়ে শিল্প-কারখানা পরিচালিত হচ্ছে, ফলে আমাদের সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে।

তিনি বলেন, ২০২৬ এ আমাদের এলডিসি গ্রাজুয়েশন স্থগিত করতে হবে, কারণ আমরা এখন বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছি তাছাড়া এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছিল বেশকিছু ভুল তথ্যের ভিত্তিতে।

তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের আমদানি ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে, পাশাপাশি কমেছে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যসংযোজন।

তিনি জানান, গ্যাসের সংকটের অভাবে আমরা ফেব্রিক্স তৈরি করতে পারছি না ফলে এ ধরনের পণ্য আমদানিতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় হচ্ছে। পাশাপাশি তিনি বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান জানান।

মুক্ত আলোচনায় ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী, ডিসিসিআইর সাবেক সভাপতি হোসেন খালেদ, রিজওয়ান রাহমান অংশ নেন।

বক্তারা ব্যবসায়ীদের হয়রানি রোধ, ভোটের স্বার্থে পকেট অ্যাসোসিয়েশন তৈরি বন্ধ করা, এবং হোল্ডিং ট্যাক্স না বাড়ানোর ওপর জোরারোপ করেন।

ডিসিসিআই ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মালিক তালহা ইসমাইল বারী, সহ-সভাপতি মো. জুনায়েদ ইবনে আলী, পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা, সাবেক সভাপতিরাসহ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *