বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৩, ২০২৫
বৃহস্পতিবার, মার্চ ১৩, ২০২৫

ময়মনসিংহে টক-মিষ্টি জিলাপি, প্রতিদিন বিক্রি লাখ টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক : পবিত্র রমজানে ময়মনসিংহের ভোজন প্রিয়দের কাছে ইফতার আইটেমের অন্যতম উপকরণ নগরীর জিলা স্কুল মোড় এলাকার জাকিরের টক-মিষ্টি জিলাপি। দিন দিন এই জিলাপির জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকায় চলতি রমজানে দৈনিক এক থেকে দেড় লাখ টাকার জিলাপি বিক্রি হয় এই দোকানে।

সম্প্রতি নগরীর জিলা স্কুল মোড়ের জাকির হোসেনের ‘মেহেরবান’ হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, টক-মিষ্টি জিলাপি কিনতে মানুষের ভিড় জমেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা এই জিলাপির স্বাদ নিতে এসেছেন। অথচ তখন অন্যান্য ইফতারের দোকানগুলো মাত্র সাজিয়ে বসতে শুরু করেছে।

জানা যায়, জাকির হোসেন জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার বালিয়ান ইউনিয়নের তেলিগ্রাম এলাকার বাসিন্দা। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট জাকিরের স্কুলের বারান্দায় হাঁটার সৌভাগ্য হয়নি। অভাবের তাড়নায় ১৯৭৩ সালে শহরে এসে মইনুল হোসেনের চায়ের দোকানে কাজ নেন। এর এক বছর পর নগরীর জিলা স্কুল মোড়ের হোটেল মেহেরবানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। তখন এই দোকানটির মালিক ছিলেন নগরীর বাসিন্দা মইনুল হোসেন। ১৯৯৩ সালের দিকে তিনি হোটেল চালাতে না পেরে জাকির হোসেনকে দায়িত্ব দেন। এর পরের বছর টক-মিষ্টি জিলাপি তৈরি করেন জাকির।

একদিন বৃষ্টির কারণে দোকানে ক্রেতা না আসায় জিলাপির জন্য প্রস্তুত করা ময়দা আর চিনি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। পরে তিনি ময়দার সঙ্গে তেঁতুলের টক আর মাসকলাই মিশিয়ে তৈরি করেন বিশেষ ধরনের জিলাপি। ক্রেতার অভাবে দোকানের অন্য কর্মচারীদের জাকির খেতে দেন সেই জিলাপি। তখন তারা জিলাপি খেয়ে ভিন্ন এক স্বাদের সন্ধান পান। এরপর পরেদিন একইভাবে জিলাপি বানিয়ে বিক্রি করলে ভোক্তারা জিলাপির প্রশংসা করেন। আর এভাবেই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে জাকিরের টক-মিষ্টি জিলাপি। তবে ২০১২ সাল থেকে এই জিলাপির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে এবং মান বৃদ্ধির জন্য জিলাপি তৈরিতে ঘি ব্যবহার শুরু হয়। এতে ক্রেতা সন্তুষ্টিও বেড়েছে। চালের গুড়া, মাষকলাই ও ময়দা গুলিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হয়। এরপর কড়াইয়ের গরম তেলে ভেঁজে জিলাপির আকৃতি দেন কারিগর। জিলাপিগুলো গাঢ় বাদামি রং করে ভেজে নেওয়ার পর অপর একটি পাত্রে চিনি, পানি, দারুচিনি ও এলাচ দিয়ে সিরা তৈরি করা হয়। এরপর গরম সিরায় ছেড়ে দেওয়া হয় ভাজা জিলাপি। এভাবেই তৈরি হয় টক-মিষ্টি জিলাপি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, সময়ের ব্যবধানে শহরজুড়ে বহু জিলাপির দোকান গড়ে উঠেছে। রমজান এলে বিভিন্ন জমকালো রেস্তোরাঁসহ অলিগলিতে ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হয়। কিন্তু সেটি জাকির হোসেনের তৈরি টক-মিষ্টি জিলাপির সঙ্গে কেউ টেক্কা দিতে পারে না। ফলে এখনো দেদারসে বিক্রি হচ্ছে ঐতিহ্যের এই জিলাপি।

জিলা স্কুল মোড় থেকে জিলাপি কিনতে আসা মাহফুজ বলেন, ২০ থেকে ২৫ বছর যাবত এই জিলাপি কিনে খাচ্ছি। অন্য সব জিলাপি থেকে এ জিলাপির স্বাদ আলাদা। জিলাপি চিবোতে শুরু করলেই পাওয়া যায় মচমচে, রসালো, টক-মিষ্টি একটা স্বাদ। যা খুবই ভালো লাগে। ফলে রমজান এলে এই দোকান থেকে জিলাপি নিয়ে যাই। পরিবারের সবাই একসঙ্গে ইফতারে মজা করে খাওয়া হয়।

বাপ্পী মজুমদার জেলার গৌরীপুর উপজেলা থেকে শহরের কাচিঝুলি এলাকায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। তিনিও কিনছেন এই জিলাপি। তার সঙ্গে কথা হলে বাপ্পী বলেন, বোনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। তাই নামকরা এই জিলাপি কিনতে এসেছি। এর আগে কয়েকবার এই দোকানে বসে জিলাপি খেয়েছি। অন্য জিলাপির চেয়ে এর স্বাদে ভিন্নতা আছে।

দোকান কর্মচারীরা জানান, প্রথমে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতো এই জিলাপি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে উপকরণের দাম। ফলে বৃদ্ধি পেয়েছে জিলাপির দামও। বর্তমানে এই টক-মিষ্টি জিলাপি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকা কেজি দরে। অমৃতি ২৬০ ও ঘিয়ে ভাজা স্পেশাল টক-মিষ্টি জিলাপি ৩৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি ইফতারি হিসেবে বেগুনি ১০, আলুর চপ ১০, ডিম চপ ১০, চিকেন চপ ২০, শাকের বড়া ৫ টাকা পিস ও পিয়াজু ৫ টাকা পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া নিমকি ২৪০, বুন্দিয়া ২০০, ছোলা বুট ২০০ ও ঘুগনি ১৬০ কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

জাকির হোসেনের ছেলে আশিকুর রহমান বলেন, রমজান এলে জিলাপি বিক্রির ধুম পড়ে। ইফতারের আগে ক্রেতাদের চাপ সামলানো কঠিন। দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করছেন। তারপরও দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে জিলাপি কিনে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে ক্রেতাদের।

তিনি আরও জানান, বছরের অন্যান্য সময় প্রতিদিন প্রায় দুই মণ বিক্রি হলেও শুধু রমজান মাসে প্রতিদিন ছয় থেকে সাত মণের বেশি জিলাপি বিক্রি হয়। এরমধ্যে প্রায় সবাই কেনেন ঘিয়ে ভাজা স্পেশাল টক-মিষ্টি জিলাপি। রোজার প্রথম দিন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার জিলাপি বিক্রি হয়েছে।

মো. জাকির হোসেন বলেন, টক-মিষ্টি জিলাপির প্রধান উপকরণ হলো মাসকলাই ডাল, ময়দা, চালের গুঁড়ার সঙ্গে তেঁতুল। প্রতিবারই জিলাপি ভাজতে নতুন তেল ব্যবহার করা হয়। ফলে এর স্বাদ ও মান ব্যতিক্রম।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *