বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪
বৃহস্পতিবার, ডিসেম্বর ৫, ২০২৪
জাতীয়

কারাগার থেকে পলাতক ৭০০ বন্দি এখনও অধরা

নিজস্ব প্রতিবেদক : গণঅভ্যুত্থানের সময়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কারাগার থেকে পলাতক ২২ শতাধিক আসামিদের মধ্যে এখনও ৭ শতাধিক আসামি অধরা রয়েছে। এরমধ্যে ৭০ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ঝুঁকিপূর্ণ কারাবন্দি বলে জানিয়েছেন কারা অধিদফতরের প্রধান কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন।

বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার কারা অধিদফতরের কারাগারের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি তথ্য জানান।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী সহিংসতা ও সরকার পতনের উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে দেশের কয়েকটি কারাগারে বন্দিরা বিশৃঙ্খলা-বিদ্রোহ করেন উল্লেখ করে কারা অধিদফতরের প্রধান বলেন, ‘বাইরে থেকেও কোনও কোনও কারাগারে চালানো হয় হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ। এই পরিস্থিতিতে কারাগারগুলো থেকে মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন, বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিসহ বিচারাধীন মামলার ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়ে যায়। যার মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে গ্রেফতারের পর আবারও কারাবন্দি করা হয়েছে। তবে এখনও ৭০০ বন্দি পলাতক। এদের মধ্যে মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী, ৭০ জন জঙ্গি ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও আছে।’

এসময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন জানান, কারাগার থেকে এখন পর্যন্ত আলোচিত ১৭৪ আসামিকে আদালত থেকে জামিন বা মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জন শীর্ষ সন্ত্রাসী মুক্তি পেয়েছে। মুক্তির বিষয়টি সম্পূর্ণ আদালতের। আমরা আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য।

কারাগারের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের ঘটনার দেশের যেসব কারাগার থেকে বন্দি পালিয়েছে, তার প্রতিটি ঘটনা আমরা তদন্ত করেছি। সেখানে আমাদের অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ও কারাগারের বাইরে নিরাপত্তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তায় ত্রুটি পাওয়া গেছে। আমরা প্রতিটি বিষয়ই গুরুত্ব সহকারে প্রস্তাবনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো হয়েছে।

জুলাইয়ের অভ্যুত্থানে প্রথম বন্দী পালনের ঘটনা ঘটে নরসিংদীর কারাগারে। এই ঘটনার সর্বশেষ অবস্থার বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ঘটনায় জেল সুপারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। তার যদি অবহেলা পাওয়া যায়, তাহলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হবে। এই ঘটনা ২০১ জন কারারক্ষী আহত হয়েছিল। পাশাপাশি কারারক্ষী ও কারা কর্মকর্তাদের বাস ভবনেও হামলা ও লুটপাট করা হয়েছে। আমরা তাদের সহযোগিতার উদ্যোগ নিয়েছি।

সম্প্রতি শাহবাগের বিএসএমএমইউ হাসপাতালে গ্রেফতার অবস্থায় চিকিৎসাধীন সাবেক এক সংসদ সদস্যের ওপর হামলার ঘটনার দায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আইজি প্রিজন্স বলেন, ‘আমাদের অনেক সময় বন্দিদের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নিয়ে যেতে হয়। পিজি হাসপাতালে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার দায় আমরা এড়াতে পারি না। কারণ সেখানে আমাদের কারারক্ষীরা ছিলেন। তবে আমাদের দায়িত্বরত কারারক্ষীদের তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থার কারণে বড় কোনও ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু সেখানে নিরাপত্তার অভাব ছিল। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি, যাতে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা না ঘটে। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তখন আর বন্দীদের সরকারি হাসপাতালে পাঠাতে হবে না।’

বর্তমানে কারাগারে বন্দির সংখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আগে অনেক মানুষকে গ্রেফতার হয়েছিল। সেই সময়ে বন্দি-সংখ্যা বেড়েছিল। পরবর্তী সময়ে সেটি কমে আসে। আমাদের সবসময়ই ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকে। আমাদের ধারণা ক্ষমতা ৪২ হাজার। ৫ আগস্টের আগে বন্দী ছিল ৫৫ হাজার। যদিও পরে সেই সংখ্যা কমে গিয়েছিল। এখন আবার বন্দির সংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী; যার সংখ্যা ৬৫ হাজার।’

কারা অধিদফতরের লোগো পরিবর্তন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন কারা অধিদফতরের লোগোতে নৌকা ও অন্যান্য বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। অনেকেই আমাদের প্রশ্ন করে কারা অধিদফতরের লোগোর সঙ্গে নৌকা সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা? তখন আমরা এমন প্রশ্নের কোনও উত্তর দিতে পারি না। কারণ এ উত্তরের কোনও নথি বা জবাব আমাদের কাছে নেই। তাই আমরা কারা অধিদফতরের লোগো পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা খতিয়ে দেখছি, যাতে পরিবর্তন যৌক্তিক হয়।’

কারাগারে কতজন ডিভিশন পেয়েছেন। রাজনৈতিক বন্দীদের ডিভিশন দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে আইজি প্রিজন্স বলেন, কারাগারে দুই ধরেন ডিভিশন দেওয়া হয়। একটা হলো প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা ও একটা হল যারা সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাদের বিষয় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সিদ্ধান্ত দেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই পেয়েছেন। আবার অনেকের আবেদন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

লিখিত বক্তব্যে কারা মহাপরিদর্শক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন। বলেন, ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’ এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশের সব কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তুলতে কারা অধিদফতর কাজ করে যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় কারা প্রশাসনেও বেশ কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা ও বন্দিদের সব ধরনের প্রাপ্যতা বিধি-বিধান নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। কারাবন্দি ও কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কারাগার নিয়ে সংবাদ প্রকাশের বিষয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের ওয়ার্ড বা সেলে মোবাইল ফোন জ্যামার স্থাপন করাসহ সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে এবং প্রতিদিন কয়েক বার তল্লাশি করা হয়। ফলে তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনও সুযোগ নেই। বিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে, আয়েশি জীবনযাপনের কোনও সুযোগ নেই। সম্প্রতি এসব বিষয়ে কিছু সংবাদ প্রচার করার ফলে জনমনে কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য পৌঁছাচ্ছে বলে কারা কর্তৃপক্ষ মনে করে। এসব ব্যাপারে প্রমাণ সাপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের আহ্বান জানান তিনি।

গত তিন মাসে কারাগারের কার্যক্রম তুলে ধরে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন বলেন, কারা অভ্যন্তরের সব ধরনের তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ দ্রব্যাদির প্রবেশ রোধ প্রবেশপথে বডি স্ক্যানারসহ অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়েছে। কারা অভ্যন্তরে মাদক প্রবেশ ঠেকাতে কারাগারগুলোতে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।

কারাগারগুলোতে সৎ ও যোগ্য অফিসার এবং কারারক্ষীদের পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা সদর দফতরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে পদায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে অপসারণসহ তাৎক্ষণিক বদলি ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে আমাদের কিছু আইনি দুর্বলতার রয়েছে। যে সুযোগ নিয়ে তারা আবারও অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত পড়ছেন। ফলে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কারা প্রধান জানান, কারাবন্দি ব্যবস্থাপনার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কারাগার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সফটওয়্যারসহ, আরএফ আইডি এবং জিপিএস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সেবা প্রত্যাশীদের সহায়তার জন্য ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরের করতে বন্দীদের প্রশিক্ষণসহ তাদের উৎপাদন শীলতা বৃদ্ধিতে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এজন্য বিজিএমই সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লাইন স্থাপনের করার কাজ চলছে।

বিভিন্ন মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কারা অধিদফতরের লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কারাবন্দিদের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণ এবং ৬৯টি কারাগারের মধ্যে ১৭টি ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *