২০ বছর ধরে শিকল বন্দি শংকরী গুহ
নেত্রকোনার দুর্গাপুরে ২০ বছর ধরে শিকল বন্দি মানসিক ভারসাম্যহীন শংকরী গুহ । পৌর শহরের আমলাপাড়া স্বর্গীয় শম্ভুলাল গুহের তৃতীয় সন্তান তিনি। এছাড়াও রয়েছে বড় দুই বোন ছোট আরো একটি ভাই। প্রচন্ড মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও এখন তার জীবন কাটছে চার দেয়ালে বন্দি হয়ে। পরনে কালো রঙের জামা পুরাতন হয় ছিড়ে হয়েছে কয়েক টুকরো। তা দিয়েই কোনরকমে ঢাকা শরীর টুকু। মাথার চুল গুলো শক্ত হয়ে বেঁধেছে জটলা।
মেধাবী এই শিক্ষার্থী শহরের বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করেছেন দীর্ঘদিন। পড়াশোনাকালীন বাবার মৃত্যুতে থমকে যায় তাদের পুরো পরিবার। বাবার শোক কাটিয়ে মামার বাড়ীতে থেকে বেশ কয়েকদিন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও দারিদ্রতার কারণে নবম শ্রেণীর গণ্ডি পেরোতে পারেননি।
পড়াশোনা বন্ধ করে বাড়িতে সংসারের কাজে মনোনিবেশ শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে হঠাৎ করে একদিন নাকের সমস্যা দেখা দিলে কয়েকদিনের ব্যবধানে তা রূপ নেয় টিউমারে। পরিবারের সদস্যরা এর চিকিৎসা করে ভালো করলেও এরপর থেকে হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে আচরনের। একপর্যায়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
এখান থেকেই শুরু তার বন্দিজীবন। পায়ের কখনো বা মোটা রশি কিংবা শিকল বেঁধে শুরু হয় আটকে রাখার চেষ্টা। পাগল মেয়েকে কোনরকম শান্ত রেখে সবসময় দেখে শুননা করছেন তার মা। তবে ২০১৩ শেষের দিকে তার মায়েরও মৃত্যু হলে সংসারের পুরো বোঝা কাঁধে পড়ে ছোট ভাই জীবন লাল গুহের। স্থানীয় একটি প্যাথলজিঞ্জতে সামান্য পিয়নের চাকরি করে কোনরকম সংসার চালিয়ে গেলেও বোনের চিকিৎসার অর্থ যেন কোনভাবেই যুগিয়ে উঠতে পারেন না ভাই।
তাছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে ভাঙা চোরা টিনের এই একটিমাত্র ঘর। ঘরের দুটি রুমে গাদাগাদি করে থাকেন ৫ সদস্যের পরিবার। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না পেয়ে বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের সাথে পরিত্যক্ত টয়লেটের উপর টিনের বেড়া দিয়ে তার ভেতর রেখেন মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে।
এরপর থেকেই এর ভেতরেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন শংকরী। সর্বদা নিশ্চুপ থেকে কুটীরের ভিতর লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। কারো সাথে কথা বলেন না তিনি বাহির থেকে কেউ কিছু দিলে তার ভেতরে নিয়ে চুপচাপ বসে খেতে থাকেন। করেন না গোসলও তাই অপরিচ্ছন্ন ও ছেরা কাপড় পড়ে পার করছেন বছর পর বছর।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমরা শংকরী কে এভাবেই এক ঘরের ভিতরেই দেখে আসছি। আমি কখনোই তাঁকে বাহিরে আসতে দেখি নাই গোসল করতে দেখিনি। খাওয়া-দাওয়া পয়:নিষ্কাশন সবকিছু তিনি ঘরের ভিতরে করেন। কারো সাথে কোন কথা বলেন না তাছাড়া দুর্গন্ধের কারণে কেউ তার সামনেও যায়না। এভাবে একটা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে। তার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তার ভাই ও অনেক গরিব মানুষ। আর্থিক সংকটের কারণে তাই বোনটিরও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেন তাহলেই হয়তো শংকরী আবারও নতুন জীবনে ফিরতে পারেন।
শংকরীর স্কুল জীবনের সহপাঠী শ্যামল রায় জানান, শংকরের সাথে আমরা ছোটবেলা থেকেই একসাথে খেলাধুলা এবং পড়াশোনা করেছি। তিনি অনেক মেধাবী একজন ছাত্র ছিলেন। বেশিরভাগ সময় তিনি মামার বাড়ি শিবগঞ্জ থেকেই বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পড়াশোনা করতেন। হঠাৎ করেই কি জানি হয়ে গেল তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যায়। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন তবুও তাকে ভালো করতে পারেনি। বাবা-মা দুজনই মারা গেছেন। তার একমাত্র ভাই সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে আর চিকিৎসা করতে পারেননি। তাই সে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমানে আসে যেখানে থাকে পাগলের মতোই ভাঙ্গাচুরা জায়গার মধ্যে রোদ্র হলে পড়ছে আবার বৃষ্টি হলে ভিজছে। এখন তার সামনে যাওয়ার মতই কোন পরিবেশ নাই। বর্তমান সরকার তো অনেকেই মানুষকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন। তাকেও একটু ভালো চিকিৎসা দেয়া যেতো তাহলে সেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো বলে আমরা মনে করি।
শংকরী গুহের ভাই জীবন লাল গুহ জানান, হঠাৎ করেই আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। নাকে একটু সমস্যা হয়েছিলো টিউমারের মতো এরপর থেকেই তার এই সমস্যা হইছে। আমরা ডাক্তার দেখাইছি ওষুধ খাওয়াইছি তারপরও কোনো কাজ হইছে না। আজ প্রায় ২০ বছরের উপরে হয়ে গেছে তাঁর এই মানসিক সমস্যা। তার এই অবস্থা দেখে তো আমার অনেক কষ্ট লাগে কিন্তু কি করবো। আমার তো কোন সামর্থ্য নাই। সামান্য একটা চাকরি করে তাদের কোনো রকমে সংসার চলে। নিজের ঘর ভেঙ্গে পড়তাছে এখন তার জন্য একটা ঘর করে দেবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। ৪/৫ জনের পরিবার চলার সমস্যা আর্থিক সংকট। তাই এখন তার কোন চিকিৎসা করতে পারতেছিনা।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিব উল আহসান জানান, বিষয়টা আমাদের নজরে ছিলোনা আমরা মাত্র জানলাম। মানবিক এই বিষয়গুলো নিয়ে আগে থেকেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে আমরাও রুড লেভেলে কাজ করে যাচ্ছি। সে ক্ষেত্রে আমরা অবশ্যই এটা পরিদর্শন করব। মানসিক ভারসাম্যহীন শংকরী গুহের প্রয়োজন গুলো আমরা সরকারি স্কিমের ভেতর থেকেই তা ফুলফিল করার চেষ্টা করবো। প্রাথমিকভাবে তার বাসস্থানের জন্য টিন সহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা যাবে। পাশাপাশি সে যদি বুদ্ধি প্রতিবন্ধি কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ভাতারও ব্যবস্থা করে দিবো।