মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৭, ২০২৫
মঙ্গলবার, জানুয়ারি ৭, ২০২৫
নেত্রকোনালীড নিউজ

হাওরাঞ্চলে বিপন্ন দেশীয় মাছের বহু প্রজাতি

নেত্রকোনা সংবাদদাতা : এক সময় জেলার দশটি উপজেলার বিভিন্ন নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর এলাকাতে প্রচুর পরিমাণে নানা প্রজাতির দেশীয় সুস্বাদু মাছ পাওয়া যেতো।

তবে দিন দিনই এসব মাছ কমে যাচ্ছে। বিপন্ন হচ্ছে দেশীয় মাছের বহু প্রজাতি।

এদিকে স্থানীয় মাছ বাজারগুলোতে আগের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে মাছের মূল্য। দেশীয় মাছের দাম একেবারে অনেকেরই নাগালের বাইরে। তবে চাহিদা বেড়েছে পুকুরে চাষ করা পাঙ্গাশসহ কার্পজাতীয় মাছের।

এ অবস্থায় মাছের দেখা না পাওয়ায় অনেক কষ্টে দিন কাটছে জেলার শত শত মৎস্যজীবী পরিবারের। কেউ কেউ পেশা বদল করে জীবিকা নির্বাহের তাগিদে যুক্ত হয়েছেন অন্য পেশায়।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলায় মোট ৬৮টি হাওর রয়েছে। এ ছাড়া নদ-নদী ও খাল-বিলের সংখ্যা ১৮৮টির মতো। সব মিলিয়ে জলাশয়ের পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার ৩১৫ হেক্টর। এরমধ্যে হাওরের আয়তন ৫৬ হাজার ৬৭৬ হেক্টর। জেলার উন্মুক্ত জলাশয়ে বছরে শতকরা ৪৫ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় এবং বাকী ৫৫ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় পুকুরে। বছরে জেলায় ৫৬ হাজার মেট্রিক টন মাছের চাহিদা থাকলেও উৎপাদন হয় প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মেট্রিক টন। জেলার ৪৮ হাজার ৩৮৪ জন নিবন্ধিত মৎস্যজীবী মাছ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং অনিবন্ধিত মৌসুমী জেলে রয়েছেন আরো প্রায় ১২ হাজার। তারা মুক্ত জলাশয়ে মাছ ধরে সংসার চালান।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বর্ষাকাল মাছের মৌসুম। এ সময় নদ-নদী ও হাওর-বিলগুলোতে মাছের প্রজননের ফলে বংশবিস্তার ঘটে। কিন্তু এমন সময় নিষিদ্ধ বিভিন্ন প্রকার জাল যেমন কারেন্ট জাল, ভরজাল, ভেসাল জাল, চায়না দুয়ারি জাল, ম্যাজিক জাল ইত্যাদি দিয়ে পোনা মাছ নিধন শুরু করেন স্থানীয়রা। বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে বোরো আবাদের সময় হাওরের জমিগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ এবং বর্ষা মৌসুমে কিছু অসাধু মৎস্যজীবী নির্বিচারে গ্যাস ট্যাবলেট প্রয়োগ করে মাছ ধরার কারনে দেশীয় মাছের সংকট বেড়েছে। ফলে মাছ ধরার মৌসুমেও এখানকার জলাশয়গুলোতে আশানুরূপ মাছ পাওয়া যায় না। বিশেষ করে ভাদ্র মাসের শেষে হাওরাঞ্চলসহ নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি কমতে শুরু করে এবং আশ্বিন মাসের প্রথম থেকেই প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা পড়তে শুরু করে। তবে এ বছর জেলার নদ-নদী ও হাওর-বিলে তেমন মাছ পান না জেলেরা। এছাড়া বেশির ভাগ উন্মুক্ত জলাশয় প্রভাবশালীদের দখলে থাকায় সেখানে জেলে ও সাধারণ মানুষকে মাছ ধরতে না দেওয়ায় চরম বেকায়দায় রয়েছেন জেলেসহ সাধারণ লোকজন।

জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের মৎস্যজীবী ক্ষিতীন্দ্র বর্মণ বলেন, আমাদের বাপ-দাদারা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আমরাও করছি। কিন্তু এখন আগের মতো মাছ না পাওয়ায় জীবন চালাতে কষ্ট হচ্ছে। তাই এখন উজান থেকে চাষ করা পাঙ্গাশ মাছ কিনে এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছি। আর আমার অন্য ভাইয়েরা পেশা বদল করে বর্তমানে কৃষি কাজ করছে।

একই উপজেলার বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, আমাদের এলাকার হাওর, নদী-বিলে কমপক্ষে ৩০ প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেতো। এরমধ্যে সিলুন মাছ, দেশীয় পাঙাশ, বাছা, এলং, লাছো, চিতল, মেনি, রানী মাছ অন্যতম। কিন্তু শুকনো মৌসুমে হাওরের জমিগুলোতে অবাদে কীটনাশক ব্যবহার ও বর্ষা মৌসুমে অসাধু মৎস্যজীবীরা গ্যাস ট্যাবলেট প্রয়োগ করে নির্বিচারে মাছ নিধনের ফলে এখন মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, চরম হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্রও।

জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার জেলে আরাধন বর্মন বলেন, আগে আমাদের এলাকার নদ-নদী ও হাওরে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু বর্তমানে জাল ও নৌকা নিয়ে সারা রাত নদীতে মাছ ধরার চেষ্টা করেও কোনো মাছ পাওয়া যায় না।

সামান্য যা পাই তা দিয়ে জীবন চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া হাওর ও বিলগুলো অন্যদের দখলে। তাই সেখানে আমাদের মাছ ধরতে দেওয়া হয় না।

জেলার মদন মাছ বাজারের ব্যবসায়ী সাইকুল মিয়া বলেন, বর্তমানে হাওর, নদী ও বিলের মাছ বাজারে তেমন একটা আসে না। যা আসে সবই পুকুরে চাষ করা মাছ। হাওর-বিলের মাছ কম থাকার কারনে পুকুরের মাছের চাহিদা ও দাম দুটোই বেশি।

মাছের ক্রেতা জেলা শহরের কুড়পাড় এলাকার বাসিন্দা জসিম উদ্দিন বলেন, বাজারে দেশি মাছ যেন এখন সোনার হরিণ। পুকুরে চাষ করা মাছও কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। দিন দিনই আমরা প্রাকৃতিক জলাশয়ের মাছের স্বাদ ভুলে যাচ্ছি। এক সময় আমার এলাকার নদী, নালা, খাল-বিল ও হাওরগুলোতে প্রচুর পরিমাণে শিং, কই, মাগুর, গুতুম, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, আইড়, শোল, মহাশোল, বাতাই, রাণী মাছ, পুঁটি, টাকি, চান্দা, গজার মাছ পাওয়া যেতো। এসব মাছ ছিল খুব সুস্বাদু। বর্তমানে এসব মাছ নাই বললেই চলে।

জেলার খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা কেন্দুয়া উপজেলার সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ আজহারুল আলম বলেন, নানা কারনেই দেশি প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত চার মাস দেশিয় প্রজাতির ছোট মাছ না ধরে প্রজনন ক্ষেত্র সংরক্ষণের কথা থাকলেও কেউ তা মানছেন না। বিভিন্ন প্রকার জাল দিয়ে পোনা মাছ ধরার ফলে কমছে মাছের প্রজন্ম। তাই পুকুরে চাষ করা মাছই এখন ভরসা। তবে উন্মুক্ত জলাশয়গুলোতে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আমরা জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছি। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে নিষিদ্ধ জাল উদ্ধারসহ জড়িতদের জরিমানা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে জেলা মৎস্য মো. শাহজাহান কবীর বলেন, এরইমধ্যে টেংরা, শিং, কই মাছসহ বিপন্ন প্রজাতির কিছু মাছ কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ফিরিয়ে এনেছেন মৎস্য গবেষকরা। রাণী মাছসহ আরো কিছু মাছ ফিরেয়ে আনার গবেষণা চলছে। পুকুরে মাছ উৎপাদন বেশি হলেও জেলার বাসিন্দাদের মাছের চাহিদা মিটিয়েও দেশের বিভিন্ন স্থানে নেত্রকোনার মাছ সরবরাহ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *