শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদভারে মূখরিত ময়মনসিংহের শিক্ষাঙ্গন
করোনা ভাইরাসের আতংকে বিশে^ দীর্ঘতম টানা প্রায় ৭৮ সপ্তাহ এবং ৫৪৩ দিন বন্ধ থাকার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় খোলায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মূখোমুখি হয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পদভারে মূখরিত শিক্ষাঙ্গন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলায় শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও অভিভাবক সবাই খুশি। সকলের প্রত্যাশা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের ক্ষতি যেন শিক্ষকরা পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দীর্ঘ বন্ধের পর গতকাল সারা দেশের মত খুলেছে ময়মনসিংহের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ। এ উপলক্ষ্যে রবিবার সকালে ময়মনসিংহ নগরীর অন্যতাম সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুল পরিদর্শন করেন ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোঃ ইকরামুল হক টিটু। এ সময় তিনি শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকগণের সাথে আলাপ করেন এবং করোনা স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে সকলকে অনুরোধ জানান।
এ সময় প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ চাঁন মিয়া, ৯ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ আবুল হোসেন ও ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান শিক্ষক মোঃ চাঁন মিয়া জানান, তার স্কুলে সর্বমোট শিক্ষার্থী ৪ হাজার। তন্ম্যধ ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম দিনে ১০ম শ্রেণী ২০২১ ও ২০২২ ব্যাচ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৪র্থ শ্রেণীসহ ৫টি ক্লাসের মোট ১ হাজার ৭০০ শিক্ষার্থীকে ক্লাসে আসার রুটিন করে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীর ৯৫ শতাংশই উপস্থিত ছিল। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে দুুপুর ২টা পর্যন্ত প্রত্যেক ক্লাসে ২টি করে ক্লাস নেয়া হয়। ৬ ফুট প্রত্যেক ব্যাঞ্চে দুই প্রান্তি দুইজন করে শিক্ষার্থীকে বসানো হয়।
স্কুলে প্রবেশের প্রথমেই থার্ম্যাল স্ক্যানার দিয়ে শরীরের তাপমাত্র মাপা হয়, এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পড়ে, সাবান পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সেখানে দু’হাত ধুয়ে ক্লাসে প্রবেশ করানো হচ্ছে। এসব কাজে শিক্ষরা জড়িত ছিলেন।
ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসার মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, তিনি ময়মনসসিংহ নগরী ও ত্রিশাল এবং ভালুকা উপজেলা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন।
দীর্ঘ ৫৪৩ দিন পর সন্তানতুল্য ছাত্রীদের কাছে পেয়ে ময়মনসিংহের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন ‘আজকের দিনের যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আমি আমার জীবনে মনে হয় কখনোই এত আনন্দিত হইনি, এত উচ্ছ্বসিত হইনি। ১৮ মাস পরে আমার সন্তানরা আমার কাছে এসেছে, তাদের সামনাসামনি দেখছি। এই দিনটির প্রতীক্ষায় এত দীর্ঘ সময় আমরা ছিলাম।’
শিক্ষার্থীদের বরণ করে নিতে স্কুলটিতে ছিল ভিন্ন আয়োজন। বেলুন দিয়ে বানানো হয়েছে গেট, ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে অভ্যর্থনা। এতদিন পর বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষকদের এমন আয়োজন বাড়তি আনন্দ দিয়েছে শিক্ষার্থীদের।
বিদ্যাময়ী স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবাসসুম তহুরা বলেন, এত দিন পর স্কুলে এসে সত্যি অনেক ভালো লাগছে। বন্ধ থাকাকালীন আমাদের অন্য রকম এক মানসিকতা ছিল, আজ নিজের ভেতরে প্রফুল্লতা ফিরে পেলাম। স্কুলে এসে স্যার-ম্যামদের কাছ থেকে এমন সারসাইজ পাব, তা ভাবতে পারিনি।
ময়মনসিংহের আরেক স্বনামধন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে গিয়েও দেখা গেছে লাইন ধরে ঢোকানো হচ্ছে ছাত্রদের। তারপর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে প্রবেশ করানো হচ্ছে শ্রেণিকক্ষে। দূরত্ব বজায় রেখে বেঞ্চে বসানো হয়েছে।
জিলা স্কুলের ছাত্র মোমেন মাহমুদ বলে, সবকিছুই যেন নতুন মনে হচ্ছে। এখন পড়ায় মন বসবে। অনলাইন ক্লাস করতেও মনটা এই ক্লাসরুমেই পড়ে থাকত। খুব মিস করতাম বন্ধুদের। অবশেষে আজ স্যার-বন্ধুদের কাছে পেয়েছি। আমরা খুবই আনন্দিত।
কথা হয় এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গেও। ছেলে-মেয়েদের স্কুলমুখী করতে পেয়ে খুশি তারাও। আছমা আক্তার নামের এক অভিভাবক বলেন, দেশে সবকিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু আমরা এই দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। আশা করছি, ছেলে-মেয়েরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তাদের কিছুই হবে না।
জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহসিনা খাতুন বলেন, ছেলেদের তিন ফুট দূরত্বে বসানো হচ্ছে। তাদের মনকে উৎফুল্ল রাখার জন্য খেলাধুলারও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিফট ভাগ করে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। আগে চার শিফটে ক্লাস করানো হলেও এখন আট শিফট করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীরা স্কুলে ফেরায় যে শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই খুশি, তা নয়। একই রকম উচ্ছ্বাস কর্মচারীদেরও মাঝেও। অনুভূতি জানতে চাইলে রেজিয়া খাতুন নামের এক আয়া বলেন, এতদিন স্কুলটিতে ছিল শুধুই শূন্যতা। সব সময় ছাত্রীদের জন্য মন পুড়েছে। আজ আবার তাদের পেয়ে কী যে আনন্দ লাগছে, তা বোঝাতে পারব না। তাদের ছাড়া তো কিছু ভালো লাগে না।
স্কুলের সামনে গত সাত বছর ধরে চটপটি বিক্রি করেন রুবেল মিয়া। শিক্ষার্থীরা ক্লাস শেষ করেই ছুটে আসত তার দোকানে। কিন্তু গত দেড় বছরের বেশি সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি বলেন, এত দিন ব্যবসায়ও খারাপ অবস্থা ছিল। আজ আবার তারা আসছে। আমারও খুব খুশি লাগছে।
জানা গেছে, জেলায় ২ হাজার ১৪০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৬৫ জন। এ ছাড়াও মাধ্যমিক ৬৬৫টি ও উচ্চমাধ্যমিক ৭৭টি বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা রয়েছে ৩৮৮টি। প্রায় ১২ লাখের মতো শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে ক্লাসে ফিরবে।