লাখ-সোয়া লাখের গরুতেই চোখ : অপেক্ষা ‘কাল পরশুর’
নিজস্ব প্রতিবেদক : কোরবানির পশু কিনে হাট থেকে বাড়ি ফেরা, পথিমধ্যে ‘দাম কত হলো’ চিরচেনা জিজ্ঞাসা, পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে হাটে যাওয়া, দেখে বুঝে, দরদাম করে কেনা পশুটি নিয়ে বাড়ি ফেরা— ঈদুল আজহার প্রস্তুতি মানেই এমন নানান আয়োজন। সবমিলিয়ে কোরবানির ঈদের আগে রাজধানীতে পশুর হাট কেন্দ্রিক একটি উৎসবের আমেজ বিরাজ করতে শুরু করেছে।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু ও ছাগলসহ নানা পশু রাজধানীর হাটগুলোতে বিক্রির জন্য তুলেছেন বিক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের সরব উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে ওঠে হাটগুলো। তবে এখনও সেভাবে গরু বিক্রি শুরু না হলেও গত দুই-তিন দিনের তুলনায় বিক্রি কিছুটা বেড়েছে। আগামীকাল থেকে ঈদের আগের রাত পর্যন্ত ভালো বেচাকেনা হবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিক্রেতারা।
হাটের সব পথেই দেখা মিলেছে গরু কিনে বাড়ি ফেরা মানুষের, তবে সেই সংখ্যাটা এখনও তুলনামূলক কম। আগামীকাল থেকে গরুর গলায় বাঁধা রশি হাতে অনেকেই বাসায় ফিরবেন বলে উল্লেখ করছেন বিক্রেতারা। তবে এখনও যারা গরু কিনছেন, ফেরার পথে পুরো রাস্তা জুড়েই একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে— ‘ভাই দাম কত হলো?’
কোরবানির পশুর হাট থেকে গরু কেনার পর যারা বাড়ি ফিরতে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে এটি একটি চিরচেনা প্রশ্ন। অন্যদিকে যাদের বাসা হাট থেকে কিছুটা দূরে, তারা পিকআপ ভ্যানে গরু নিয়ে ফিরছেন। তবে গরুর বহনের গাড়ি বা পিকআপ ভ্যানের ভাড়া অতিরিক্ত বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ গরুর ক্রেতাদের।
বুধবার (৪ জুন) বেশ কয়েকটি হাট ঘুরে ক্রেতা, বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় আকৃতির গরু তুলনামূলক কম বিক্রি হচ্ছে। তবে সিংহভাগ ক্রেতাদের চাহিদায় আছে মাঝারি ও ছোট আকৃতির গরু। বলতে গেলে এক থেকে সোয়া লাখ টাকা দামের গরুর দিকেই ক্রেতাদের বেশি আকর্ষণ এবার। হাটগুলোতে এই ধরনের গরুর বিক্রির সংখ্যাই বেশি।
বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মূলত কাল, পরশু— এই দুই দিন সবচেয়ে বেশি গরু বিক্রি হবে বলে আশা করছেন। ফলে ঢাকার হাটগুলোতে ‘কাল পরশুর’ অপেক্ষায় আছেন বিক্রেতারা। সেই সঙ্গে যেসব পাইকার বা বিক্রেতারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বড় গরু ঢাকায় এনেছেন, তারা অনেকটাই হতাশার মধ্যে আছেন, কারণ এখন পর্যন্ত সেভাবে বড় আকৃতির গরু বিক্রি হচ্ছে না।
তবে তারা বলছেন, ঈদের আগের রাতের হাট প্রতিবারই লটারির রাত হিসেবে সবাই জানে, ওই রাতে হয় দাম বাড়বে, নয়তো কমবে। তবে এখন পর্যন্ত ক্রেতাদের ভাষ্য, ছোট-মাঝারি সাইজের গরুর দাম বেশি। অন্যদিকে বিক্রেতাদের দাবি, এবার অন্যবারের তুলনায় গরুর দাম কম। যা নিয়ে তৈরি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় অস্থায়ী গরুর হাটে কথা হয় সিরাজগঞ্জ থেকে ৭টি গরু নিয়ে আসা বিক্রেতা শহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ঢাকার প্রতিটি হাটেই গরুর সরবরাহ অনেক। সব হাটেই আমাদের পরিচিত বিক্রেতারা আছেন। তবে এখনও সেভাবে গরু বিক্রি শুরু হয়নি। মূলত কাল, পরশু এই দুই দিন গরু বেচাকেনা হবে। এখন পর্যন্ত ছোট-মাঝারি সাইজের গরুই ক্রেতারা বেশি কিনছে, দরদামও হচ্ছে এসব গরু নিয়েই। বড় গরুর দাম সেভাবে কেউ করছে না। আমার ৭টা গরুর মধ্যে ২টা বড়, যেগুলোর দাম এখনও কেউ করেনি। বড় গরু নিয়েই ভয়ে আছি।
একই হাটের আরেক বিক্রেতা গফুর মিয়া গরু এনেছেন কুষ্টিয়া থেকে। তিনি গরুর দামের ধারণা দিয়ে বলেন, মোট ১৩টা গরুর মধ্যে মাঝারি সাইজের গরু এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে তিনটি। মোটামুটি বলতে গেলে তিন মণের একটি গরুর জন্য চাওয়া দাম ছিল দেড় লাখ টাকা, সেই গরুর দাম ক্রেতারা এক লাখ টাকা বলছে। ঈদের আগের রাত পর্যন্ত ধরে রাখব, এরপর দরকার হলে কেনা দামে ছেড়ে দেব। তবে মানুষ বড় গরুর দরদাম সেভাবে এখনও করছে না।
রাজধানীর ৩০০ ফিটের সাইদ নগর হাটের গরুর দরদামের ধারণা নিতে এসেছেন গুলশানের বাসিন্দা নরুল হুদা। তিনি বলেন, হাটে প্রচুর গরু আছে। তবে সেভাবে এখনও ক্রেতা নেই। যদিও ঢাকার মানুষ শেষ সময়ে গরু কেনে, কারণ গরু রাখার জায়গার সমস্যা। আমিসহ কয়েক বন্ধু মিলে আজ হাটে ঘুরলাম, দেখলাম হাটে মাঝারি গরুই সবাই দেখছে। ছোট-মাঝারি সাইজের গরুর দাম একটু বেশি, তবে সেই তুলনায় বড় গরুর দাম কমই আছে। ঘুরে দেখলাম দেড় লাখের মধ্যেই গরু কিনতে হবে। আজ ধারণা নিয়ে গেলাম, হয়ত ঈদের আগের রাত কিনব।
রাজধানীর শাহজাহানপুরের হাটের গরু বিক্রেতা মোজাম্মেল হক বলেন, বড় গরু এনে কিছুটা ভীত, মনে হচ্ছে বড় গরুর বাজার এবার কমই থাকবে। তবে মাঝারি সাইজের বেশ কয়েকটা গরু বিক্রি হয়ে গেছে। এখন হাটে যেসব ক্রেতা আসছে তারা মূলত দরদাম যাচাই করতেই আসছে, কেনা ক্রেতার সংখ্যা আজ পর্যন্ত কম। আগামীকাল থেকে বিক্রি বাড়বে বলে আশায় আছেন বিক্রেতারা।
আগামী ৭ জুন দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। ঈদের চার দিন আগে থেকে রাজধানীতে পশুর হাট বসে। সে হিসাবে গতকাল মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকার দুই সিটি এলাকায় কোরবানির পশুর বেচাবিক্রি শুরু হয়েছে। এ বছর স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলিয়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কোরবানির হাট চূড়ান্ত হয়েছে মোট ১৯টি। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় বসছে ১২টি পশুর হাট। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় বসছে ৭টি পশুর হাট। এর বাইরের বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ীভাবে কিছু কিছু হাট বসিয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটির আওতাধীন একমাত্র স্থায়ী পশুর হাট গাবতলী ছাড়াও অস্থায়ী হাটগুলো হলো— মিরপুর-৬ নম্বর সেকশনে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাট, মোহাম্মদপুর এলাকার বছিলা ৪০ ফুট সড়ক–সংলগ্ন খালি জায়গায় হাট, উত্তরা-১০ নম্বর সেক্টর-সংলগ্ন রানাভোলা অ্যাভিনিউ খালি জায়গার হাট, ভাটারা সুতিভোলা খালের পাশে খালি জায়গার হাট, খিলক্ষেতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচের খালি জায়গায় হাট, খিলক্ষেত থানাধীন ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের মস্তুল চেকপোস্ট–সংলগ্ন খালি জায়গার হাট, তেজগাঁওয়ে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন খালি জায়গার হাট, উত্তরা দিয়াবাড়ি ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টর–সংলগ্ন বউ বাজারের খালি জায়গার হাট, কাচকুড়া বাজার-সংলগ্ন রহমাননগর হাট, মেরুল বাড্ডা কাঁচাবাজার হাট এবং রামপুরার পূর্ব হাজিপাড়ার ইকরা মাদ্রাসার খালি জায়গায় হাট।
দক্ষিণ সিটির আওতাধীন একমাত্র স্থায়ী হাট সারুলিয়া ছাড়াও অস্থায়ী হাটগুলো হলো— ডেমরার আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পাশের খালি জায়গায় হাট, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পাশে নদীর পাড়ে খালি জায়গায় হাট, দনিয়া ক্লাবের পূর্ব পাশে ও ছনটেক মহিলা মাদ্রাসার পশ্চিমের খালি জায়গায় হাট, লালবাগের পোস্তা এলাকায় রহমতগঞ্জ ক্লাবের খালি জায়গায় হাট, উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘ ক্লাবের খালি জায়গায় হাট এবং হাজারীবাগে ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের খালি জায়গায় হাট।