মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতাদের বিশৃঙ্খলা, কঠোর অবস্থানে শীর্ষ নেতৃত্ব
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ উঠছে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। ‘পুকুর চুরি’ থেকে বেফাঁস মন্তব্য, দখল, সহিংস কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতারা। তবে, নেতাদের এসব বাড়াবাড়ি দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। যখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাকে দল থেকে বহিষ্কার কিংবা পদ স্থগিত করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দলের চেয়ারপারসন-ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ভিডিও বার্তায় এবং মহাসচিবের পক্ষে বার্তা দেওয়া হয়- দলের কেউ যেন হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটে না জড়ায়। দলের নাম করে কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও তুলে দিতে। একইসঙ্গে দলের পক্ষে থেকেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় বারবার। কিন্তু তারপর সারাদেশে বিএনপি-ছাত্রদল, যুবদলসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, দখল ও দলীয় শৃঙ্খলা ভঙের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। যার পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক নেতাকর্মীকে দল ও সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কাউকে-কাউকে পদ স্থগিত করে তাদের বিরুদ্ধে কেন স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তার জন্য কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘বিএনপি শৃঙ্খলাবদ্ধ দল। আমরা মনে হয়, এগুলো অন্য কেউ করে বিএনপির নাম দিয়ে দিচ্ছে। তারপওর বিএনপি সজাগ আছে, আশা করি কেউ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপির একটি বিশাল দল। তার মধ্যে কেউ লোভে পড়ে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতেও পারে। তবে, দল তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবে। বরিশাল বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদকের বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে।’
‘এটা জিয়াউর রহমানের দল। আমরা সবাই সচেতন আছি, যেন কেউ এই ধরনের কাজে লিপ্ত না হয়’ —বলেও উল্লেখ করেন মেজর (অব.) হাফিজ।
বিএনপির নেতারা বলছেন, যাদের বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠছে এবং সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে; তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে-সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এরমাধ্যমে অন্যদের বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, ভবিষ্যতেও যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠবে এবং সত্যতা পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে একই ধরনের সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যার ফলে, ধীরে-ধীরে নেতাকর্মীদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
বিএনপির সূত্র বলছেন, রাজধানীর কয়েকটি এলাকা থেকে খবর আসে, দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন জায়গা দখল করে দলীয় সাইনবোর্ড লাগিয়ে দিচ্ছে। এই রকম একটি খবর নেতাদের কাছে আসে যে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার সিটি করপোরেশনের উদ্ধার করা আলোচিত সাদিক অ্যাগ্রোর স্থানে অবৈধভাবে ২টি ঘর তুলে সেখানে বিএনপির সাইনবোর্ড লাগানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ আগস্ট বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে সেখানে গিয়ে ঘরগুলো ভেঙে দিয়ে আসে দলের ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতা আমিনুল হক। একইসঙ্গে স্থানীয় নেতাদের এই ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত না হতে সতর্ক করে দিয়ে আসেন।
সূত্র আর বলেছেন, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, সেগুন বাগিছা, খিলগাঁও, মিরপুর, ঢাকার বাইরে সাভার, নারায়ণগঞ্জ এলাকায় বিভিন্ন ঘর-দোকানপাট দখল করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের সাইনবোর্ড ঝুলানোর খবর এসেছে কেন্দ্রের কাছে। দলের পক্ষ থেকে এসব এলাকার নেতাকর্মীদের সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে দখলকৃত জায়গা ছেড়ে দিতে। এছাড়া রাজধানীর সেগুন বাগিছা, খিলগাঁও এলাকায় অবৈধভাবে দলখ করা জায়গা ছেড়ে দিয়ে মাইকিং করা হয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে।
এরআগে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, কিছু দুষ্কৃতকারী এসব করে নাম ভাঙায় বিএনপির। কিছু-কিছু জায়গায় ধরাও পড়েছে, সেখানে নামও এসেছে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী এরা। এরসঙ্গে কোনো মতেই বিএনপি জড়িত নয়। এটা বিএনপির বিরুদ্ধে অত্যন্ত পরিকল্পিত প্রপাগান্ডা হচ্ছে। আমরা এর নিন্দা জানাই।
তিনি আরও বলেন, “আমাদের দলের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে- কোথাও এই রকম কেউ করলে তাকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে ধরিয়ে দিতে। এসব মধ্যে বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে সঙ্গে-সঙ্গে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একটি সূত্র বলছেন, বিএনপির জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর ছিল— সরকার পতনের রাতেই (৫ আগস্ট) বরিশাল শহরে পুকুর দখলের অভিযোগ ওঠে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরীনের বিরুদ্ধে। যার ফলে, পরের দিনই তার পদ স্থগিত করা হয়। এরমধ্যে আবার দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতি ফলে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু। তিনি গত ১৬ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে ‘টিভি-পত্রিকায় খুনি হাসিনার ছবি ও বক্তব্য প্রচার করলে জ্বালিয়ে দেওয়া হবে’ বলে হুমকি দেন এবং বেফাঁস মন্তব্য করেন। যার কারণে তাকেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
সূত্রটি আরও বলেছেন, এরা যেহেতু দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং গত ১৬-১৭ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তাই তাদের সরাসরি বহিষ্কার না করে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের কর্মকাণ্ডে না জাড়ান।
নাম না প্রকাশের শর্তে বিএনপির সম্পাদকমণ্ডরীর এক নেতা বলেন, “সরকারের পতনের পর বিএনপির নামধানী কিছু সুবিধাবাদী লোক বিভিন্ন জায়গায় দখল, চাঁদাবাজিতে মেতে উঠেছিল। যার বেশ কিছু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশও পায়। এতে দলের শীর্ষ নেতৃত্ব নড়েচড়ে বসেন। নির্দেশনা দেওয়া হয়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে তাকে যেন সঙ্গে-সঙ্গে বহিষ্কার করা হয়। যেন কোনোভাবে দলের শৃঙ্খলা ভেঙে না পড়ে।”
সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিএনপির ২০ জনের মতো নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে যুবদলের ৫০ জনের বেশি এবং ছাত্রদলের ১৫ মতো নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দল, শ্রমিক দলের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। আর বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে কারণ দর্শনানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, “বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের যে কোনো স্তরের নেতার অন্যায়কে তিনি মেনে নেবেন না, এই বার্তা কঠোরভাবে পালন করার জন্য দলের মহাসচিবসহ শীর্ষ নেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন। একইসঙ্গে তাৎক্ষণিক কার্যকর ভূমিকা রাখার নির্দেশনা দিয়েছেন।”