মশার দাপটে অতিষ্ট ময়মনসিংহ নগরবাসী
চর-থাপ্পড়েও নিস্তার মিলছে না মশার কামড় থেকে। মশা থেকে বাচঁতে নেওয়া হয় নানা আয়োজন। প্রতিবছর মশা মারার অয়োজনে খরচ হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এই টাকা মশা নিবারণের নানা যন্ত্রপাতি, কীটনাশসহ আরো অনেক কাজে ব্যয় হয়। তারপরও মশার দাপট কমছে না। দিনদিন মশার উপদ্রব বাড়ছে ময়মনসিংহে।
৯২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ময়মনসিংহ নগরীর ৩৩টি ওয়ার্ডে বসবাস করেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। যানজট, ধুলোবালি, ময়লা-আবর্জনাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত নগরবাসীর কাছে এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে মশার উপদ্রব। মশার কামড়ে অতিষ্ঠ নগরীর বাসিন্দারা। দিনের বেলাতেও মাশারী, ¯েপ্র ও কয়েল জ্বালানো ছাড়া বাসা, অফিসে টেকা যাচ্ছে না।
গরমের শুরুতেই বেড়েছে মশার যন্ত্রণা। সম্প্রতি বৃষ্টি না হওয়ায় বেড়েছে মশা। প্রবাহ না থাকায় ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ণ ড্রেন-খালগুলো পরিণত হয়েছে মশার প্রজনন কেন্দ্রে। মশার কামড়ে সবচেয়ে বেশি বিপাকে শিশুরা। হাতে-পায়ে মশার কামড় আতঙ্ক বাড়াচ্ছে ডেঙ্গুর।
এদিকে, মশার উপদ্রব বাড়লেই বাড়ে নগর কর্তৃপক্ষের তোড়জোড়, বাকি সময় অনেকটায় নির্জীব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ক্র্যাশ প্রোগাম করে মাঝে মাঝে মশা নিধনে কাজ করলে চলবে না, নিয়মিত কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে নাগরিকদেরকেও নিজেদের আশপাশ পরিস্কার রাখতে হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে এ বছর ময়মনসিংহে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে শঙ্কা চিকিৎসকদের।
নগরীর চামড়া গুদাম এলাকার আবুল হোসেন বলেন, শীত শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মশা বেড়েছে কয়েকগুন। কয়েল জ্বালানো ছাড়া বাসায় থাকা যাচ্ছে না। রাতের বেলায় মশার দাপট বাড়ে কয়েকগুণ। দিনের বেলায়ও অনেক সময় মশারি টানিয়ে চেষ্টা করেন মশা তাড়ানোর জন্য।
থানারঘাট এলাকার আব্দুল হালিম বলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে দিনে রাতে সমান মশা। কামড় দিলে ফুলে ওঠে ও চুলকায়। বাচ্চাদের দিনেও মশারির মধ্যে রাখতে হয়। সিটি কর্পোরেশনের লোকজনকে ওষুধ ছিটাতে গত এক মাসেও দেখিনি।’
নগরীর ব্রাহ্মপল্লী এলাকার গৃহবধূ ফারজানা আক্তার শাপলা বলেন, ‘মশার জ্বালায় সন্ধ্যা থেকেই মশারি টানাতে হয়। ‘জানালা খোলা যায় না। একেবারে সব মশা চলে আসে জানালা খুললেই। বাচ্চাদের স্কুল কোচিংয়ে নিয়ে গেলে ওখানেও মশা কামড়ায়।’
নগরীর হামিদ উদ্দিন রোডের বাসিন্দা কালাম বলেন, মশার যন্ত্রনায় দিনে ঘরে ও বারান্দায় কয়েল দিতে হয়। রাতে ¯েপ্রর পাশাপাশি মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হয়। এতে প্রতি মাসে গুণতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, এ বছর মশা নিধন ও বিস্তার ঠেকাতে নেয়া হয়েছে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা। গত বছরের তুলনায় এ খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়ে। মশার তীব্রতা বাড়ায় ২৩ মার্চ থেকে নগরীতে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও মশক নিয়ন্ত্রণে ওয়ার্ডভিত্তিক ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে। ওয়ার্ডগুলোতে লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড প্রয়োগ করা হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন মশক নিধন খাতে পাঁচ বছরের হিসেবে দেখা যায় এ খাতে বরাদ্দ থাকলেও সবটুকুই খরচ হয় না। চলতি ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে ফগার মেশিন ক্রয় ও মেরামত, কীটনাশক ক্রয়, শ্রমিকদের মজুরি ও প্রচারণা খাতে বাজেট রাখা হয়েছে ১ কোটি টাকা। ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে এ খাতে ৬৫ লাখ টাকা বরাদ্দের মধ্যে খরচ হয় ৬০ লাখ টাকা। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার মধ্যে ব্যয় হয়েছে ১ কোটি ২৬ লাখ ৯৯ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে ১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ব্যয় হয় ১ কোটি ৭৬ লাখ ২৯ হাজার টাকা। ২০২০-২১ অর্থ বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও খরচ করা হয় ৭৮ লাখ ৯৭ হাজার টাকা।
অন্যদিকে, মশার উপদ্রব বাড়লে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশক নিধন অভিযান শুরু হয় বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা। অন্য সময় নগর কর্তৃপক্ষের কোনো তৎপরতা থাকে না নগরীতে।
সিটি করপোরেশনের খাদ্য ও সেনিটেশন কর্মকর্তা দীপক মজুমদার বলেন, মশার উৎপত্তি স্থল ড্রেনগুলো পরিস্কার পরিচ্ছনতা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে একা কাজ করে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সাধারণ মানুষকেও সচেতন করতে লিফলেট বিতরন করার পাশাপাশি বিভিন্ন বাসাবাসিতে লার্ভা শনাক্তকরন কাজ চলছে।
ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আমীন কালাম বলেন, নগরীর অনেক ড্রেনগুলো নিয়মিত সংস্কার ও পরিষ্কার হয় না। সেখানে জমে থাকা পানি মশার প্রজননের প্রধান ক্ষেত্র। মাঝে মাঝে সিটি করপোরেশন মশা মারার জন্য ওষুধ ছিটালেও তা কার্যকর হচ্ছে না। আমরা প্রতিনিয়ত সিটি কর্তৃপক্ষকে মশা নিধনে তাগিদ দিচ্ছি। সেই সাথে সাধারন নাগরিকদের বলবো তারা যেন তাদের আশপাশ নিয়মিতভাবে পরিস্কার রাখে। এতে মশা অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মহির উদ্দীন বলেন, ‘লার্ভা দমনের জন্য যে ওষুধ প্রয়োগ করা হয় তা অধিক পরিমাণ পানি ব্যবহার করায় আরও বেশি ডায়লুট হয়ে যায়। এই ডায়লুট হওয়ার কারণে ওষুধের কার্যকারিতা হারায়।’ সঠিক নিয়মে প্রয়োগ না করা এবং একই ওষুধ দীর্ঘদিন প্রয়োগে কার্যকারিতা হারিয়েছে কীটনাশক। ফলে মশার উপদ্রব বাড়ছে।
অন্যদিকে, গত বছর ময়মনসিংহ মেডিকেলে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন ৩ হাজার ৭৩৩ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় ১৩ জনের। দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হলে এবছর ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে শঙ্কা চিকিৎসকদের।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. মহিউদ্দিন খান মুন বলেন, ‘আমরা এই বছর যদি ডেঙ্গু মশার বিস্তার রোধ করতে না পারি, এবং জনগণের সচেতনতা না বাড়ে তাহলে এ মহামারি এবারও ব্যাপকভাবে হবে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।’
ময়মনসিংহের সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ শীতের শেষে গরমের শুরুতে মশার বংশবৃদ্ধি বেশি হয়। ড্রেন বা ময়লার ঝোপঝাড় পরিষ্কার না করলে মশার বংশবৃদ্ধি বেড়ে যাবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ তখন বেড়ে যেতে পারে।’
উল্লেখ্য, মশার লার্ভা ধ্বংস করতে ও মশক নিধনে মাছ ও ব্যাঙ ভূমিকা রাখবে এমন প্রত্যাশায় ৫০ হাজার মাছের পোনা ও ১০ হাজার ব্যাঙ ছাড়া হয়েছিল ময়মনসিংহ নগরীর বিভিন্ন ড্রেন ও খালে। ৫০ হাজার মাছ ও ১০ হাজার ব্যাঙ ‘উপহার’ হিসেবে পেয়েছিল সিটি করপোরেশন। এর মধ্যে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্লিনআপ বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ২০২১ সালের ১১ জুন প্রায় ৫০ হাজার তেলাপিয়া ও খলিসা মাছের পোনা সিটি করপোরেশনকে উপহার দেয়। নগর কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিক ভাবে নগরীর বিভিন্ন খালে ও ড্রেনে সেই মাছ গুলো ছেড়েছিল। কিন্তু আবর্জনায় ভরা ড্রেন ও খালে নেওয়া উদ্যোগ পুরোটাই বৃথা গেছে।