শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
শনিবার, নভেম্বর ২৩, ২০২৪
আলোচিত সংবাদব্রেকিং নিউজলীড নিউজশিক্ষা

স্কুলগুলোতে ঈদ আনন্দ, প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর শিক্ষার্থীরা

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্রী শারমিন রিহা। সকালে মায়ের সঙ্গে স্কুলে এসেছে। দুপুর ২টার দিকে ক্লাস শেষ করে বের হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সেলফি তুলতে দেখা যায় তাকে। এত দিন পর স্কুলে এসে কেমন লাগছে, জানতে চাইলে রিহা বলে, এ যেন ঈদের দিনের মতো। ঈদের দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে যেমন আনন্দ হয়, তেমন আনন্দ হচ্ছে আজ। দীর্ঘদিন পর স্কুলে আসতে পেরেছি, প্রিয় শিক্ষক-বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে, এতেই আমি টানা দেড় বছর বাসায় থাকার কথা ভুলে গেছি। সবার মাস্ক পরা থাকলেও বন্ধুদের চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি বলেও জানায় এ শিক্ষার্থী।

রিহাই শুধু নয়, এদিন তার মতো শত শত শিক্ষার্থী জানায়, দীর্ঘদিন পর তারা স্কুলে আসতে পেরে অনেক খুশি। তাদের এ খুশিতে শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকরাও খুশি। স্কুল খোলার প্রথম দিন শিক্ষকরাও তাদের সঙ্গে হাসিখুশিভাবে কুশলবিনিময় করেছেন।

প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণ থেকে স্কুলের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সুরক্ষিত রাখতে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি না হওয়ায় দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলেও কয়েক দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে সম্প্রতি ১২ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আগামী অক্টোবরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও খুলে দেওয়া হতে পারে।

সরেজমিনে রোববার (১২ অক্টোবর) দুপুরে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের পদচারণায় রাজধানীর প্রায় সব ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণই ছিল হাসি-আনন্দে ভরপুর। শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মুখে ছিল মাস্ক। দুপুরে স্কুল ছুটি হলে বন্ধুদের নিয়ে একসঙ্গে ভ্রাম্যমাণ দোকানের আচার, ঝালমুড়ি, ডাব, আইসক্রিম খেতেও দেখা যায় শিক্ষার্থীদের।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরেক শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবা নূর ঊর্মিলা স্কুলে আসতে পারার অনুভূতি প্রকাশ করেন এভাবে, এ যেন আমার কাছে একটি স্বপ্নের দিন। কখনো কল্পনাতেই ছিল না, আজ আমার বন্ধুদের দেখবো, তাদের সঙ্গে কথা বলবো, হাসবো, একই সুরে গান গাইবো। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দেখেও অনেক ভালো লেগেছে। ক্লাসে পড়াশোনার চাইতে আজ স্বাস্থ্যবিধি মানা ও পরিবারের সবাইকে নিয়ে করোনামুক্ত থাকার বিষয়ে শিক্ষকরা পরামর্শ দিয়েছেন বেশি। যদি প্রতিদিন ক্লাস করতে পারতাম, তাহলে আরও খুশি লাগতো।

দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানজিলা তাসনীম অরিন বলেন, এতদিন পর স্কুলে আসতে পেরে সত্যিই আনন্দ লাগছে। টানা বাসায় থাকতে থাকতে আমরা সবাই অনেক ক্লান্ত ছিলাম। স্কুল খোলায় ক্লান্তি নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। এতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে পেরে জীবন ধন্য হয়ে গেছে।

রাফিয়া আনজুম রাফা বলেন, এতদিন আমরা অনলাইন ক্লাস করলেও শিক্ষক ও বান্ধবীদের কাছে পাইনি। তাই সে সময়টায় পড়াশোনায় কোনো আমেজ ছিল না। স্কুলে এসে সত্যি অনেক ভালো লাগছে। স্কুল বন্ধের সময় আমাদের অন্য রকম এক মানসিকতা ছিল, আজ নিজের ভেতরে প্রফুল্লতা ফিরে পেলাম। এখানে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সবকিছু করছি। দোয়া করি, শিক্ষার্থীরা সুস্থ থাকুক। আমরাও সবার কাছে দোয়া চাই। আশা করি আর স্কুল বন্ধ হবে না।

আসমাউল হুসনা মীম নামের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী বলেন, আমরা অনেক দিন ধরে ঘরবন্দি। স্কুল খুলে দেওয়ায় কী যে আনন্দ লাগছে, বোঝাতে পারব না। কতদিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলো। প্রতিদিন যদি ক্লাস হতো, আমার কী যে খুশি লাগত।

শিরিন আক্তার শিমু নামের একজন শিক্ষক বলেন, আজকের দিনের যে অনুভূতি তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমি আমার জীবনে মনে হয় কখনোই এত আনন্দিত হইনি, এত উচ্ছ্বসিত হইনি। দেড় বছরের বেশি সময় পরে আমার সন্তানেরা আমার কাছে এসেছে, তাদের সামনাসামনি দেখছি। এই দিনটির প্রতীক্ষায় এত দীর্ঘ সময় আমরা ছিলাম।

আনোয়ার হোসেন নামের একজন অভিভাবক জানান, দেশে সবকিছুই খুলে দেওয়া হয়েছে অনেক আগে। কিন্তু আমরা এ দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। আশা করছি, ছেলে-মেয়েরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে তাদের কিছু হবে না।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা অবিভাবকদের সঙ্গে এলেও মেইন রোড থেকে স্কুলের সড়কে একা যেতে হচ্ছে। স্কুলের শিক্ষকরা মেইন রোড থেকে শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিচ্ছেন। স্কুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের তাপমাত্রা নির্ণয় করা হচ্ছে। হাতে দেওয়া হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার। প্রত্যেককে মাস্ক পরা অবস্থায় স্কুলে প্রবেশ করতে হচ্ছে। প্রিয় শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষকদের কাছে পেয়ে শিক্ষার্থীরাও দারুণ উৎফুল্ল।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের স্কুলের সামনে গত পাঁচ বছর ধরে চটপটি বিক্রি করেন হাফিজ শেখ। শিক্ষার্থীরা ক্লাস শেষ করেই ছুটে আসতো তার দোকানে। কিন্তু গত দেড় বছরের বেশি সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি। তিনি বলেন, এতদিন ব্যবসাও খারাপ ছিল। আজ আবার তারা আসছে। আমারও খুব খুশি লাগছে।

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, স্কুল-কলেজ খুললেও সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে স্কুলে যেতে পারবে না। শুধু ২০২১ ও ২০২২ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন (সপ্তাহে ছয় দিন) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে। এদের সঙ্গে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির মধ্যে যে কোনো একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পর্যায়ক্রমে এক দিন করে যাবে। দুটি করে ক্লাস ধরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে রুটিন তৈরি করেছে।

এদিকে, স্কুল খোলার প্রথম দিন সকালে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে শ্রেণিকক্ষ অপরিচ্ছন্ন রাখায় আজিমপুর গভর্নমেন্ট গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর হাছিবুর রহমানকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। সেইসঙ্গে তার নেতৃত্বে গঠিত মনিটরিং কমিটির সদস্য শিক্ষকদেরও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সবার সচেতনতা এক রকম নয়। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাবেন, তাদের একটু সচেতন থাকতে হবে। স্কুলের প্রতিটা আনাচে-কানাচে খুঁজে দেখতে হবে, কোথাও যেন ময়লা না থাকে।

তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি কন্ট্রোল রুম করা হয়েছে। পরে এর নম্বরগুলো প্রচার করা হবে। যে কেউ এসব নম্বরে ফোন দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যার কথা জানাতে পারবেন। আমরা তা সমাধানে ব্যবস্থা নেবো।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *