দীর্ঘদিন পর লকডাউন তুলে নেয়ার পর ময়মনসিংহের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা হলেও প্রতিদিন অসংখ্য বার লোড শেডিংয়ের নামে ঘণ ঘণ বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে। প্রচন্ড তাপদাহ এবং অসনীয় গরমের কারণে ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠা খোলা রাখতে পারছে না। বিদ্যুৎ না থাকলে ক্রেতারাও মার্কেটে গিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজ বাসায়। এছাড়াও ময়মনসিংহের আবাসিক বাসা-বাড়িতেও ঘণ ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে নারী-শিশু শিক্ষার্থীসহ সকলেই অসহ্য গরমে কারণে যন্ত্রণা ভোগ করছেন এবং ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের দাবীতে ব্যবসায়ী, নাগরিক আন্দোলন, জনউদ্যোগসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশাজীবী নেতৃবৃন্দরা বিক্ষুব্দ হয়ে উঠেছে। অবিলম্বে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না করতে পারলে তারা বৃহত্তর আন্দোলনের যাবে বলে বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েছে।
সারাদেশে চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে কিন্তু বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিগত কয়েক বছরে বিদ্যুতের ব্যবহার ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও সে তুলনায় ভবিষ্যৎ চাহিদা মোকাবেলায় দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন ও গ্রীড সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় মাস্টার প্ল্যাণ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন না হওয়ায় গ্রাহকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। দেশে অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করেও এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার অনেকটা ইমেজ পড়েছে।
ময়মনসিংহ অঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষে ৯ আগষ্ট দুপুরে দুই ঘন্টাব্যাপী মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কেন্দ্রে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় পিডিবি ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী, দুইজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, সকল নির্বাহী প্রকৌশলী, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১,২,৩ এর জিএম, ডিজিএম, শম্ভুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের জিএম, নাগরিক আন্দোলন, জনউদ্যোগ ও ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় বিদ্যুৎ বিভাগ ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোঃ রফিকুল ইসলাম জানান, ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা আছে ১১০০ থেকে ১২০০ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় ঘাটতি আছে ১০০ থেকে ১৫০ মেগাওয়াট। শম্ভুগঞ্জ আরপেসি পাওয়ার স্টেশনে ২১০ থেকে ২৫০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা থাকলেও উৎপাদন হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ মেগাওয়াট। এখানে সরবরাহ কমিয়ে ভালুকার শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ করার ফলে উৎপাদন কম হচ্ছে। জামালপুরে ৯৫ মেগায়াটের শিককদার গ্রুপের পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ, এছাড়াও জামালপুরে ইউনাইটেড গ্রুপের ২টি পাওয়ার প্ল্যান্ট সংস্কার কাজের জন্য উৎপাদন প্রায় অর্ধেক। দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হলেও ময়মনসিংহে সঞ্চালন লাইনের সক্ষমতার ঘাটতি থাকায় জাতীয় গ্রীড থেকে সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না। ইত্যাদি কারণে ময়মনসিংহ অঞ্চলের গড়ে প্রতিদিন ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লোডশেডিং এর বোঝা গ্রাহকদের বইতে হচ্ছে।
প্রধান প্রকৌশলী আরো জানান, নগরীর ভাবখালী এলাকার সৌর বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেবল দিনের বেলায় জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয়; ফলে ওই প্ল্যান্টের বিদ্যুৎ রাতের চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয় না।
অপরিকল্পিত এবং বিধি বহির্ভূত ভবন ও সড়ক নির্মাণের ফলে বিদ্যুতের খুঁটি স্থাপন ও বিদ্যুৎ লাইনের সংরক্ষণ ব্যাহত হচ্ছে। স্থান নির্বাচন না হওয়ায় ৪০০ ম্যাগাওয়াটের উপকেন্দ্র নির্মাণ করা যাচ্ছে না। উপকেন্দ্রটি নির্মিত হলে সর্বোচ্চ এক বৎসর সময়কালের মধ্যে ময়মনসিংহের বিদ্যুৎ ঘাটতি শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনা যাবে।
সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামূল হক আশ্বস্ত করে জানান, গ্রীড উপকেন্দ্র নির্মাণে শম্ভুগঞ্জের প্রস্তাবিত যায়গাটি তিনি ১২ সেপ্টেম্বর রবিবার বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে হস্তান্তর করবেন। শম্ভুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও সচিবের সঙ্গে গুরুত্ব সহকারে যোগাযোগ করবেন। জাতীয় গ্রীড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের সক্ষমতা সম্পন্ন সঞ্চালন লাইন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। অপচয় রোধে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সকল সরকারী, বেসরকারি অফিসকে মিতব্যায়ী হতে হবে। সরবরাহ স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নাগরিকদের ধৈর্য ধারণ করার জন্য অনুরোধ করেন। এছাড়াও কোন এলাকায় লোডশেডিং হলে গ্রাহকদের আগে থেকেই মাইকিং করে জানিয়ে দেয়ার আহবান জানান। বিদ্যুৎ সংক্রান্ত যে কোন তথ্য গ্রাহকদের অবহিত করার জন্য অচিরেই বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে একটি ফেইসবুক পেইজ খোলার পরামর্শ দেন জেলা প্রশাসক । ঘন ঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিরসন ও বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণের অগ্রগতি বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য ১৫ দিন পরে আবারও মতবিনিময় সভা আহবানের আশ^াস দেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের সঞ্চলনায় মতবিনিময় সভায় আরো বক্তব্য রাখেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ময়মনসিংহ সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ উবাইদুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান, নির্বাহী প্রকৌশলী- (১) মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, (২) ইন্দ্রিজিৎ দেবনাথ ও (৩) মোফাজ্জল হোসেন, পিজিসিবি নির্বাহী প্রকৌশলী মুসাদুল হক, ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (১) জিএম মোঃ আক্তার হোসেন, (২) মোঃ শাহজাহান কবীর ও (৩) খন্দকার শামীম আলম, জেলা নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার নূরুল আমিন কালাম, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাজী আজাদ জাহান শামীম, জাসদ কেন্দ্রীয় নেতা রতন সরকার, জনউদ্যোগ আহবায়ক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম চুন্নু ও যুগ্ম- আহবায়ক অ্যাডভোকেট শিব্বির আহমেদ লিটন, ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডিাস্ট্রির সিনিয়র সহ-সভাপত শংকর সাহা, ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম, মুদ্রন শিল্প সমিতির সভাপতি ইয়াজদানী কোরায়শী কাজল, রেস্তোরা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শরীফ উদ্দিন, পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রিতা সমিতির সভাপতি আবদুর রব মোশারফ প্রমূখ।
বিদ্যুতের এই সংকটময় মূহুর্তে গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ এনামুল হকের নিকট নিরবিচ্ছিন্ন বিদুৎ সরবরাহের দাবীতে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন ময়মনসিংহ দোকান মালিক সমিতি ঐক্য পরিষদ এবং জনউদ্যোগনেতৃবৃন্দ। স্মারকলিপির কপি বিদ্যুৎ সচিবকে অবহিত করা ছাড়াও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আশ^াস দেন জেলা প্রশাসক ।