সংবাদ শিরোনাম

 

অরবিন্দ পাল অখিল, ময়মনসিংহ প্রতিদিন ডটকম : ঋতুরাজ বসন্তের মাঝামাঝি সময়। বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নিতে এইচএসটিটিআই ময়মনসিংহে অবস্থান করতে হয়েছিল চল্লিশ দিন। যান্ত্রিক কোলাহল ও ইট পাথুরে শহরের মাঝে সবুজ বনানী ঘেরা এমন সুন্দর আর মনোরম পরিবেশে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (এইচএসটিটিআই) টির অবস্থান। বাংলাদেশের আর কোথাও এমন সুনিবিড় পরিবেশে এইচএসটিটিআই আছে কিনা আমার জানা নেই।
২০০৮ সালের মে মাসে ১৪ দিনের এক প্রশিক্ষণে এখানে এসে সচরাচর দেখা যায় না এমন এক জোড়া পাখি দেখেছিলাম । ইনস্টিটিউটের তৎকালীন পরিচালক প্রাণীবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. বিমল কান্ত সাহা এ চত্বরে পাখিগুলোর বিচরণের ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছিলেন। এ পাখির নাম নীলকন্ঠ।
নীলকন্ঠ  পাখি পাতি কাকের চেয়ে আকারে ছোট, অনেকটা পায়রার মতো দেখতে তবে মাথাটি অপেক্ষাকৃত বড়। পেট ও ডানার কিনারের দিকে পালক গাঢ় বেগুনী নীল। মাথায় নীলচে সবুজ রংয়ের টুপীর মতন। নাম নীলকন্ঠ হলেও কন্ঠের আশেপাশে নীলের কোন চিহ্ন নেই। গলা ও পিঠের দিকের পালক মেরুন রঙের। অচেনা এই পাখিটি দেখলে  যে কেউ কৌতুহলী হয়ে জানতে চাইবে এর নাম কি?
‘নীলকন্ঠ’র ইংরেজী নাম Indian Roller  Giv  Coraciidae পরিবারের পাখি।    বৈজ্ঞানিক নাম-  Coracias benghalensis
নীলকন্ঠ পাখিরা বেশ উঁচু স্বরে ডাকাডাকি করে । বিশেষ করে পূর্ব রাগের সময় পুরুষ নীলকন্ঠরা শুন্যে উড়তে থাকে এবং বিরামহীনভাবে ডাকাডাকি করে। ধারণা করা হয় পুরুষ পাখিটি সঙ্গিনীর মনোরঞ্জনের জন্যই এমন ডিগবাজি দিয়ে উড়ে থাকে। এরা সাধারণত জোড়ায় জোড়ায় থাকে। এদের বিচরণ ক্ষেত্রও আলাদা করে নেয় নিজেরা।
প্রশিক্ষণকালীন নীলকন্ঠ ছাড়াও আর কি কি পাখি  দেখা গেছে ময়মনসিংহ এইচএসটিটিআই চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকায় তার একটি বিবরণ দেয়া হল । ছোট পাখি টুনটুনি বিভিন্ন প্রজাতির মৌচুষি দেখতে পাওয়া গেছে বাগানগুলোতে। সেখানে দেখা ছোট পাখির  পরিচয় দেয়া সম্ভব না হলেও বড় পাখির বর্ণনা করা হল। রবীন্দ্র মঞ্চের কাছের অশত্থের ডালে বসা খয়েরি চিল আর শঙ্খ চিল প্রায়ই দেখা গেছে। কোকিলের প্রণয় গাঁথা ডাক আর কোকিলার লুকিয়ে থাকা পাখা ঝাপটানোর শব্দ নুতন পাতায় মোড়া সব গাছেই কম বেশী দেখা মিলেছে। তারা পুরো বসন্তটাই মাতিয়ে রেখেছিল সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি।
পেছনের গেইটে  কোর্ট এর দিকে যেতে মজা খালটির ডানদিকের ঝোপটিতে একটি ডাহুকের লুকিয়ে আসা যাওয়া চোখ এড়াবে না পাখি দেখিয়েদের। হোস্টেল বা মূল ভবনের ছাদে ও কার্ণিশে ঝাকে ঝাকে জালালী কবুতর দেখা যায় সব সময় । দুপুরে তিলে ঘুঘুর পরিচিত ডাক আমাদের হারিয়ে যাওয়া ঘুঘুর কাছের প্রজাতি সবুজ হরিয়াল এর সাজুয্য আনার বৃথা চেষ্টা মনটাকে আসলেই ভারাক্রান্ত করে তুলে। ল্যাবেরেটরী স্কুলের প্রশাসনিক ভবনের সামনে খেজুর গাছে টিয়াদের ক্যাচ ক্যাচানী জানান দেয় আশেপাশে কোথাও এদের বাসা রয়েছে। ঘুরে দেখা  গেছে জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার সামনে বিশাল আকৃতির একটি কড়ই এবং কৃষ্ণচূড়া গাছের কোটরে কোটরে অসংখ্য টিয়া তাদের আবাসস্থল গড়ে তুলেছে। পার্শ্ববর্তী ব্রহ্মপুত্র নদে পানকৌড়ির ঝাঁক, সাদা বক আর সাদা খঞ্জন তো আছেই।
ডাইনিং হলে দুপুরে খাবার খেতে এসে জানালা দিয়ে অনেক সময় দেখা গেছে হলদে রঙের ইষ্টিকুটুম। সকালে পিটি প্যারেড করার সময় ইলেক্ট্রিক তার ও ছোট ছোট গাছে সবুজ রঙের বড় বসন্তবাউরি অনেকেরই দৃষ্টি কেড়ে নেয়। শুকনো ডালে  পোকামাকড় খেতে ব্যস্ত বাদামী রঙের ‘কাঠ শালিক’ যারা পাখি বিষয়ে একেবারে অনভ্যস্ত তাদের এই কাঠ শালিক দেখালে শালিকের অন্য ধরণের যেমন গো শালিক, ভাত শালিক ও ঝুঁটি শালিকের ছবি চোখে ভেসে উঠবে। যেগুলো সবসময়ই এইচ টি টি আই চত্বরে দেখা যায়। ভর দুপুরে গাছের ছায়ায় লাফিয়ে চলা পুরুষ দোয়েলের শিষ দিয়ে সঙ্গী খোঁজার দৃশ্য প্রতিদিনই দেখা গেছে। আলেকজেন্ডার ক্যাসেলের সামনের খেজুর ও আম গাছে দল বেঁধে সোনালী পিঠ কাঠ ঠোকরাদের ঝগড়া মনে করিয়ে দেয় এ যুদ্ধটা কিসের সংগী নির্বাচন না খাদ্যের জন্য মারামারি। এ এলাকায় ধুসর শির কাঠঠোকরা দেখা গেছে দু একটা। মসজিদের সামনের পুকুরের কিনারে ঢোল কলমী গাছে পাতি মাছরাঙার রঙ অবশ্যই মনটাকে রাঙায়। আলেকজান্ডার ক্যাসেলের পিছন দিকে পুরোনো গাছগাছালির নীচে নিবিড়ে আধার সংগ্রহে ব্যস্ত কাল ও খয়েরী রংয়ের একটি কানকোয়া বা কোবো পরিপূর্ণতা দিয়েছে। সকাল বিকাল যে সময়ই হেটে যাতায়াত করেছি সাত ভায়লা বা ছাতারে দেখা গেছে সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই ক্যাম্পাসে বড় ও ছোট দু’ ধরণের ছাতারে আছে। ইংরেজীতে এদের Babler বলে।
ময়মনসিংহের এইচএসটিটিআই চত্বর ও এর আশেপাশের এলাকা যে আসলেই পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কাামিনী ফুল ও ঝোঁপে ঝোঁপে ফিঙ্গে পাখির অনেক বাসা। তারা নিরাপদে ডিমে তা দিচ্ছে। এ থেকেই বুঝা যায় এখানে যারা বসবাস করেন তারা পাখিদের পরম বন্ধু। কেননা যদি তা না হত তবে কখনোই এত নীচে তারা বাসা বেঁধে ডিম দিত না।
আমাদের শিশুদের পাখি চেনানো ও পাখিদের প্রতি আগ্রহী করতে ছোট পরিসরে শুরু করাটাই অনেক বড় একটা কাজ। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে পাখি দেখার সময় যেন পাখিরা নিজেরা ডিস্টার্বড (আতংকিত) না হয়। পাখিরা আমাদের কাছে নিরাপদ থাকুক এমন প্রত্যাশা করছি। এইচএসটিটিআই ময়মনসিংহের তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর আব্দুল আউয়াল খান, এ ক্যাম্পাস ও আশেপাশের এলাকাটিকে পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল গড়ে তুলতে চেষ্টা চালাবেন বলেছিলেন।
সুত্রঃ ১. 1. Pocket Guide to the Birds of the Indian Subcontinent by Richard Grimmett, Carol Inskipp, Tim Inskipp. ২. বাংলাদেশের পাখপাখালি- সাজাহান সরদার, ৩. সাধারণ পাখি- সালিম আলি ও লাইক ফতেহ আলি।

লেখকঃ নান্দাইল সমূর্ত্ত জাহান মহিলা কলেজের জীববিজ্ঞানের শিক্ষক। সৌখিন পাখি পর্যবেক্ষক।


মতামত জানান :

 
 
 
কপিরাইট © ময়মনসিংহ প্রতিদিন ডটকম - সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | উন্নয়নে হোস্টপিও.কম