বাড়তে পারে যেসব পণ্যের দাম
প্রতি বছর নতুন বাজেট ঘোষণার পর বেশ কিছু পণ্যের দামের পরিবর্তন ঘটে। কিছু পণ্যে শুল্ক ও কর প্রত্যাহার করে সরকার। এতে কিছু পণ্যের দাম কমতে দেখা যায়। আবার কিছু পণ্যে নতুন করে কর আরোপ করার ফলে অনেক পণ্যেরই দাম বেড়ে যায়।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট ঘিরেও সাধারণ মানুষের আগ্রহ হচ্ছে– কোন কোন জিনিসের দাম বাড়তে বা কমতে পারে। এতে দেখা যায়, নতুন করে যত পণ্যের দাম বাড়তে যাচ্ছে, সে তুলনায় দাম কমবে খুব অল্প পণ্যের।
এবার প্রায় অর্ধশত পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট হার এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। এতে সব শ্রেণির মানুষকে সমানভাবে ভ্যাটের ভার বইতে হবে। এ তালিকায় থাকা মোবাইল ফোন, সিসি ক্যামেরা, ক্যাবল, এসি ও ফ্রিজের মতো ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দাম বাড়তে পারে।
এবার দেশীয় ইলেকট্রনিক পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়তে পারে। এসি ও এলইডি টিভি তৈরির উপকরণ আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর ফলে দেশে এসি ও টিভির দাম বাড়তে পারে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ইকুইপমেন্ট ও ইরেকশন ম্যাটেরিয়াল আমদানিতে শুল্ক আরোপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে পণ্যের উৎপাদন খরচে।
বাড়তে পারে যেসব পণ্যের দাম–
সিগারেট
প্রতি বছরই বাজেট ঘোষণার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় সিগারেটের দাম বৃদ্ধিকে ঘিরে। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিবারের মতো এবারও বাজেটে সিগারেট উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য স্তর বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ও বর্ষীয়ান কূটনীতিক আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
তিন স্তরের সিগারেটে সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বাড়বে সব ধরনের সিগারেটের দাম। বাজেটে প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য বাড়িয়ে ৪৮ টাকা এবং একই পরিমাণ গুলের মূল্য ২৫ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুধু সিগারেট বা জর্দাই নয়, রাজস্ব আয় বাড়াতে বাজেটে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট এবং আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন তিনি।
কম্পিউটার
দেশে এখন যেকোনও আমদানিকারক কোনও শর্ত ছাড়াই ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক দিয়ে সব ধরনের কম্পিউটার ও প্রিন্টারের যন্ত্রাংশ আমদানি করতে পারেন। এই সুবিধা প্রত্যাহার করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে কম্পিউটারের দাম বাড়তে পারে।
কাজুবাদাম
দেশে কাজুবাদাম চাষকে সুরক্ষা দেওয়ার অংশ হিসেবে খোসা ছাড়ানো কাজুবাদাম আমদানিতে শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে কাজুবাদামের দাম বাড়তে পারে।
ফ্রিজ
বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের ইলেকট্রনিক্স পণ্য খাতকে সরকার ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে আসছে। আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত ফ্রিজ উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতি রয়েছে, যা আর বৃদ্ধি করা হবে না বলে জানা গেছে। ফলে নতুন অর্থবছরে ৫ শতাংশ ভ্যাটের হার বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে বাজারে ফ্রিজের দাম বেড়ে যেতে পারে।
এসি
গরমে স্বস্তি পেতে অনেকে এয়ারকন্ডিশন বা এসি কিনছে। বাজেটে এসিকে বিলাসী পণ্য বিবেচনা করে দেশে এটি উৎপাদনে ব্যবহৃত কম্প্রেসার ও সব ধরনের উপকরণের শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। তাই এসির দাম বাড়তে পারে।
পানির ফিল্টার
বাসাবাড়িতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। দেশে উৎপাদন হওয়ায় পানির ফিল্টার আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। তাই গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত পানির ফিল্টারের দাম বাড়তে পারে।
এলইডি বাল্ব
বিদ্যুৎ বিল সাশ্রয়ে অনেকে এলইডি বাল্ব ব্যবহার করেন। নিকট-ভবিষ্যতে এলইডি বাল্বের দাম বাড়তে পারে। কারণ এলইডি বাল্ব এবং এনার্জি সেভিং বাল্ব উৎপাদনের উপকরণ আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়ানো হচ্ছে।
গাড়ি
বর্তমানে সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত সুবিধায় গাড়ি আমদানি করতে পারেন। বৈষম্য হ্রাসে বাজেটে এই সুবিধা বাতিল করে প্রস্তাবিত বাজেটে গাড়ি আমদানি করতে হলে সংসদ সদস্যদের ২৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবনা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। অন্যদিকে বিলাসবহুল গাড়িতে শুল্ক ফাঁকি রোধে হাইব্রিড ও নন-হাইব্রিড টাইপের গাড়ি ছাড় করতে কিছু সুনির্দিষ্ট শর্ত যোগ করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে। ফলে বিলাসবহুল গাড়ির দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
জেনারেটর
লোডশেডিং মোকাবিলায় বাসাবাড়ি বা শিল্পে জেনারেটরের ব্যবহার বাড়ছে। সেখানেও নজর দিয়েছে এনবিআর। জেনারেটর সংযোজন ও উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণ বা যন্ত্রাংশ আমদানিতে এক শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে। তাই দেশের বাজারে জেনারেটরের দাম বাড়তে পারে।
মোবাইল ফোন
বাজেটে হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে প্রতিটি হ্যান্ডসেটে দাম বাড়তে পারে ১ হাজার টাকা।
বর্তমানে হ্যান্ডসেট উৎপাদনে ৩ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হয় ১৭টি প্রতিষ্ঠানকে। বিক্রয় পর্যায়ে রয়েছে ৫ শতাংশ ভ্যাট। নতুন বাজেটে এ খাতে ভ্যাট আরও ৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এতে ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে সরকার। তবে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আনা ফোন বিক্রি বন্ধ হলে এ খাত থেকে বছরে রাজস্ব মিলবে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা।
মোবাইল ফোন সিমকার্ড
মোবাইল অপারেটরদের সিমকার্ড বিক্রির ওপর কর ২০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে বাড়তি দামে সিমকার্ড কেনা লাগতে পারে ক্রেতাদের।
কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস
কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, আমসত্ত্বের ওপর ভ্যাট পাঁচ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর আরও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ হতে পারে। ফলে বেশি দামে কিনতে হবে এসব পণ্য।
ফলের জুস
এছাড়া নতুন বাজেটে আমসত্ত্ব, ফলের জুস, ম্যাঙ্গো বার ও জুস, তেঁতুলের জুস, পেয়ারার জুস, আনারসের জুস ইত্যাদি উৎপাদনে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
হাসপাতাল সরঞ্জাম
কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতালের শুল্ক ছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ রয়েছে। আগামী বাজেটে দুই শতাধিক মেডিক্যাল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, যা গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
রূপচর্চা সামগ্রী
বাজেটে রূপচর্চা সামগ্রীর ওপর ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে। হাত, নখ, পায়ের প্রসাধন সামগ্রী, লিপস্টিক, চুল পরিচর্যা সামগ্রীতে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হচ্ছে। বিধায় কসমেটিক্স আইটেমের দাম বাড়তে পারে।
গাড়ি কনভার্সন খরচ
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যক্তিগত সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সন বেড়ে গেছে। গাড়ি সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সনের ব্যবহৃত কিট, সিলিন্ডার ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এ কারণে গাড়ি কনভার্সন খরচ বাড়তে পারে।
মোবাইলে কথা
রাজস্ব আদায়ের আওতা বৃদ্ধি করলে মোবাইলে কথা বলতে আরও বাড়তি অর্থ গুনতে হবে ভোক্তাকে। বর্তমানে একজন ভোক্তা মোবাইলে ১০০ টাকা রিচার্জ করলে ৭৩ টাকার কথা বলতে পারেন। বাকি ২৭ টাকা ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক হিসেবে কেটে নেয় মোবাইল অপারেটরগুলো। প্রস্তাবিত বাজেটে মোবাইল সেবার ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলে ভোক্তা ৬৮ টাকার কথা বলতে পারবেন।
নিরাপত্তাসেবা
এছাড়া রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরে বাসাবাড়ি, অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে নিরাপত্তাসেবা প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। এখন এ ধরনের নিরাপত্তাসেবা নিলে ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট দিতে হয়। আগামী বাজেটে এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী ।
হাটবাজারের ইজারা
কর ব্যতীত প্রাপ্তি (নন-ট্যাক্স রেভিনিউ) বাড়াতে আগামী বাজেটে জেলা, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাটবাজারের ইজারার মূল্য কিছুটা বাড়বে। সেই সঙ্গে বাড়বে জমির নামজারির মাশুলও (ফি)।
বিনোদন খরচ
অবসরে পরিবার নিয়ে সময় কাটানোর জন্য অনেকে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে ঘুরতে যান। রাজস্ব আয় বাড়াতে সেখানেও হাত দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশ এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপিত আছে। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হচ্ছে। এতে পার্কে ঘোরার খরচ বাড়বে।
ধনীদের আবগারি শুল্ক
অবশ্য ধনীদের ওপর এবার অতিরিক্ত করারোপ করা হচ্ছে। বর্তমানে ধনিক শ্রেণি ২৫ শতাংশ হারে আয়কর দেয়, আগামীতে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। বছরে আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা অতিক্রম করলে ৩০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকের আবগারি শুল্কও বাড়ানো হচ্ছে। ৫ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক হিসাব থেকে বছরে এক লাখ টাকা আবগারি শুল্ক কাটা হবে।