ত্রাণ পৌঁছায় না দুর্গম এলাকায়
সবাই রাস্তার আশপাশে ত্রাণ দিয়ে চলে যায়। ফলে প্রত্যন্ত গ্রামে যারা আছে, তাদের কাছাকাছি ত্রাণ পৌঁছায় না।
দুর্গম হওয়ায় কোমর পানি মাড়িয়ে কেউ ভেতের যেতে চায় না। ’
লক্ষ্মীপুরের বন্যা কবলিত দুর্গম মান্দারীর মোহাম্মদ নগর ও যাদৈয়া এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা বাংলানিউজের কাছে এভাবে আপেক্ষ করে কথাগুলো বলেন।
যাদৈয়া গ্রামের কিশোর রিফাত, শুভ, রূপক বলেন, ‘মহাসড়কের পাশে বসে থাকি। অনেকগুলো গাড়ি ত্রাণ নিয়ে এসেছে। ত্রাণ নিয়ে আসা স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা রাস্তার আশপাশের বাড়িতে ঢুকে ত্রাণ দিয়ে যান। তাদের আমরা বলেছি, আমরা সহযোগিতা করব, একটু ভেতরে চলুন। সেদিকের অবস্থা খুব খারাপ। পানি বেশি, চরম কষ্টে আছে লোকজন। কিন্তু ভেতরে বুক পরিমাণ পানিতে নামার ভয়ে তারা সেদিকে যাননি। ’
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া এবং মোহাম্মদ নগর গ্রাম দুটি মহাসড়ক থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার ভেতরে। মহাসড়ক দিয়ে ওই এলাকার দিকে যেতে আঞ্চলিক যে সড়কটি ব্যবহৃত হয়, সেটি পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও হাঁটু পানি, আবার কোথাও বুক পানি। পানি মাড়িয়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে ৩০-৪০ মিনিট। কিন্তু এতো দুর্ভোগ সহ্য করে ও সময় নিয়ে কোনো স্বেচ্ছাসেবী ওই এলাকায় ত্রাণ নিয়ে যেতে চাননি।
ফলে গত চার-পাঁচদিন ওই দুই গ্রামের কয়েক হাজার পানিবন্দি মানুষ ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। গ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা ভবনকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দেওয়া হয়েছে। ওখানে তিন শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
সরকারি কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি আশ্রয়কেন্দ্র দুটিতে। তবে সোমবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানি দেওয়া হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকার তিনশ পরিবারকে। এছাড়া একটি সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও কিছু খাবার বিতরণ করতে দেখা গেছে। সোমবারই প্রথম ত্রাণের দেখা পেয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দারা। যদিও তা চাহিদার তুলনায় একেবারে অপ্রতুল ছিল৷
সোমবার বিকেলে গ্রাম দুটি ঘুরে চরম মানবিক বিপর্যয় লক্ষ্য করা গেছে। গ্রামের চারদিকে পানি, কোথাও মাটির চিহ্ন দেখা যায়নি। যাদৈয়া গ্রামের পশ্চিম অংশের চিত্র আরও ভয়াবহ। সড়কের ওপর কোমর পানি, কোনো কোনো বাড়ির ভেতরে বুক পরিমাণ পানি। এমন কোনো ঘর দেখা যায়নি, যেটাতে পানি ঢোকেনি। প্রতিটি ঘরে কম-বেশি পানি ঢুকে পড়েছে। গুটিকয়েক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।
গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, সড়ক যোগাযোগ ভাল না। রাস্তা দিয়ে ভেলা বা নৌকায় চলাচল করতে হয়। পানির উচ্চতা বেশি। তাই চাইলেই বের হওয়া যায় না৷ এলাকার দোকানগুলোতেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া যায় না। প্রয়োজন পড়লেও কিছু কিনতেও পারি না। কেউ সহায়তা নিয়ে আসেনি। মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে আছি।
ওই এলাকার আন্তিয়া বাড়ির এক নারী সদ্য সন্তান জন্ম দিয়েছেন। হাসপাতালে সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হয়েছে তার। সোমবার সন্ধ্যায় একটি নৌকায় করে পরিবারের লোকজন হাসপাতাল থেকে মা এবং শিশুকে বাড়ি নিয়ে আসেন। রাস্তায় পানির উচ্চতা ছিল বুক পরিমাণ, আর উঠানে ছিল কোমর পর্যন্ত।
শিশুর খালা বলেন, কখনো ভাবিনি, বাড়ির ভেতরে নৌকায় করে নবজাতককে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু পরিস্থিতি এতো খারাপ যে নৌকায় করে মা ও তিনদিনের শিশুকে নিয়ে আসতে হয়েছে। চারিদিকে পানি, এ মুহূর্তে শিশুকে নিয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
পাশের মোহাম্মদ নগর গ্রামে গিয়েও একই দৃশ্য দেখা গেছে। সব ঘরেই কমবেশি পানি। গ্রামের গাজী বাড়ির এক গৃহকর্তাকে দেখা গেছে পানি ঠেকাতে ঘরের দরজায় ইটের আস্তর বসাচ্ছেন। কিন্তু কোনোভাবেই পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছেন না৷ ঘরের ভেতের ঢোকা পানি নিষ্কাশনে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে ঘরের অন্য সদস্যদের।
স্থানীয় খায়রুল এনাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিশুদ্ধ পানির সংকট রয়েছে। যেসব নলকূপ থেকে আশ্রয়কেন্দ্রের বাসিন্দারা পানি সংগ্রহ করতেন, সেগুলোর অধিকাংশই পানির নিচে। ফলে দূরদূরান্ত থেকে পানি আনতে হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দা নুর হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, এ এলাকার বেশিরভাগ মানুষ কৃষক, দিনমজুর, অটোরিকশাচালক। সবাই কর্মহীন এখন। খাদ্যের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সেই সঙ্গে গবাদি পশুগুলোকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের নিচে গাদাগাদি করে পশুগুলোকে রাখা হয়েছে। গোখাদ্যের সংকটও অনেক।
তিনি বলেন, আমাদের এলাকাটি প্রত্যন্ত হওয়ায় ত্রাণ সামগ্রীও পৌঁছায় না। মহাসড়কের পাশ দিয়ে ত্রাণের গাড়ি চলে যায়। সোমবার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে কিছু শুকনো খাবার ও পানি দেওয়া হয়েছে। এ মুহূর্ত চাল, ডাল জাতীয় ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন এ এলাকাতে।
ত্রাণ সহায়তা দিতে আসা স্বেচ্ছাসেবক হেলাল উদ্দিন বলেন, আমাদের এলাকা, প্রত্যন্ত এলাকায় সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু দুর্গম এলাকায় পণ্য পৌঁছাতে স্থানীয়দের সহযোগিতা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, যাদৈয়া ও মোহাম্মদ নগর এলাকাটি দুর্গম। আমরা এসে দেখলাম এখানে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ। যা মহাসড়কের পাশ থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই। আমাদের পক্ষ থেকে তিনশ পরিবারকে সহায়তা করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের বন্যা চরম অবনতি দিকে। জেলাতে প্রতিনিয়ত পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রয়োজনীয় নৌযান না থাকায় দুর্গম এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকরাও যেতে পারছেন না। ফলে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা৷ জেলার প্রায় শতভাগ এলাকা পানিতে নিচে তলিয়ে গেছে।