আওয়ামী লীগ কোনো ডিক্টেটর মিলিটারির পকেট থেকে বের হয়নি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে অতিবাম এবং অতিডান মিলে সরকার উৎখাতের চেষ্টা করলেও দেশের জনগণের সাড়া পাচ্ছেন তারা। নির্বাচন নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে, যাতে নির্বাচনটা না হয়। আমার শক্তি দেশের জনগণ। জনগণের শক্তির ওপর আমরা সবসময় বিশ্বাস করেছি এবং আমি এটাও বলতে চাই, জনগণ যতক্ষণ চাইবে ততক্ষণ ক্ষমতায় থাকব। কারণ আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এসেছি। আওয়ামী লীগ কোনো অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ডিক্টেটর মিলিটারির পকেট থেকে বের হয়নি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে।
বৃহস্পতিবার (২ মে) থাইল্যান্ড সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে বেলা সাড়ে ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এই সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ দেশের মানুষের মুক্তির জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। আওয়ামী লীগ সব সময় মানুষের কল্যাণে কাজ করে আর বিএনপি মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়।
উপজেলা নির্বাচন ঘিরে আওয়ামী লীগের দলীয় নির্দেশনা সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীর পরিবার দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন। তারা আগে নির্বাচন করেছেন। কেউ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, কেউ উপজেলা চেয়ারম্যান। তাদের তো রাজনৈতিক জীবনী আছে। তাদের মানা করি কী করে? তবে এটা ঠিক, এক জায়গায় বউকে দিল, আরেক জায়গায় ছেলেকে দিল, এগুলো ঠিক না। কর্মীদের মূল্যায়ন করা উচিত। সেটাই নেতাকর্মীদের বলতে চেয়েছি।
পারিবারিক ফর্মুলায় কারা পড়েন? নিজের ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী, এই তো? হিসাব করে দেখেন কয়জন ছেলে-মেয়ে, কয়জন স্ত্রী নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন? এর বাইরে তো পরিবার ধরা হয় না। আমাদের কথা হচ্ছে নির্বাচন যেন প্রভাবমুক্ত হয়। মানুষ যেন স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে। আমাদের লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, সবকিছু নিজেরা নিয়ে নেব, আমার নেতাকর্মীদের জন্য কিছু রাখবো না, এটা হয় না। সেই কথাটা আমি বলতে চেয়েছি। যেন প্রভাব বেশি না ফেলে। সবাই দাঁড়িয়েছে, নির্বাচন করছে, সেটার লক্ষ্য হলো নির্বাচনকে অর্থবহ করা।’
তিনি বলেন, অনেকগুলো রাজনৈতিক দল নির্বাচন বর্জন করেছে। বর্জন করে কেন? নির্বাচন করার মতো সক্ষমতাই নাই। পার্লামেন্ট নির্বাচন করতে হলে জাতিকে দেখাতে হবে যে পরবর্তী নেতৃত্বে কে আসবে, প্রধানমন্ত্রী কে হবে, নেতা কে হবে? একটা নেতা দেখাতে হবে। আপনার কাছে উপযুক্ত নেতা না থাকলে তখন তো আপনাকে ছুতা খুঁজতে হয়। নির্বাচন করলাম না,বিরাট ব্যাপার দেখালাম।আমাদের দেশে সেটাই হচ্ছে।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ বছর আগে দেশের অবস্থাটা কী ছিলো, এখন কী কোনো পরিবর্তনই হয়নি? দেশবিরোধী অনেকেই অপবাদ ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে৷ তারা মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ বাম দলগুলো এখন নব্বই ডিগ্রি ঘুরে গেছে৷ তারা তো গণমুখী দল৷ তারা আওয়ামী লীগকে উৎখাৎ করলে, কারা আসবে ক্ষমতায়? সেটা কী ভেবেছে, সেটা তো বলে না৷ তাই জনগণের সমর্থনও তারা পায় না৷
এ সময় বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, মডার্ন বাস কিনলে, বিএনপি আন্দোলনের নামে সেগুলো পুড়িয়ে দেয়৷
আওয়ামী লীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিশ্ব পরিস্থিতি দেখে নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হবে৷ শিগগিরই ১৪ দলের বৈঠক করা হবে৷ ১৪ দল না থাকার, প্রশ্নই আসে না৷ জোট শেষ হয়ে গেছে, এটাও ঠিক না, বলেন তিনি৷
মিয়ানমারে চলমান যুদ্ধপরিস্থিতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিয়ানমারের এই বিষয়টি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। বর্তমান যে পরিস্থিতি সেখানে চলছে সেটা নিয়ে থাইল্যান্ডও বেশ উদ্বিগ্ন। তবুও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চেষ্টা চলবে—এটুকু আশ্বাস থাই প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ফিলিস্তিনে অব্যাহত গণহত্যা, মিয়ানমারে চলমান সংঘাত, রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসন ও বিশ্বে চলমান সংঘাত বন্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়কে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে রিফিউজি হিসেবে আমাদের এখানে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আমরা আলোচনা করেছি। মিয়ানমারের ওপর থাইল্যান্ডের একটা প্রভাব আছে। সেক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি এটা আরও গভীরভাবে দেখবেন। প্রত্যাবর্তনের যতটা সহযোগিতা দরকার সেটা তিনি করবেন। এ ব্যাপারে তিনি কথা দিয়েছেন। মিয়ানমারের এই বিষয়টি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। বর্তমান যে পরিস্থিতি চলছে সেটা নিয়ে থাইল্যান্ডও বেশ উদ্বিগ্ন। তবুও এটা চেষ্টা চলবে, এটুকু আশ্বাস দিয়েছেন।’
থাইল্যান্ডের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘আলোচনার ক্ষেত্রে দেশের সার্বিক উন্নতি বিশেষ করে এসডিজি অর্জনের বিষয়টি (এসেছে)…। পাশাপাশি আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমরাদের সহযোগিতা প্রয়োজন, বিশেষ করে যোগাযোগটা বেশি প্রয়োজন। সেদিক থেকে থাইল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের আলোচনাটা অত্যান্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হয়েছে। তাছাড়া ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমি থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য আহ্বান করেছি। আমরা হাইটেক পার্ক ও অর্থনৈতিক জোনে তাদের জায়গা দেবো।’
থাইল্যান্ড সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী, প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান। জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলতে পারি— কী পেলাম, কী পেলাম না সেটা বড় কথা না। সহযোগিতা পাওয়ার এবং সার্বিক উন্নয়নের নতুন দুয়ার খুলে গেলো। সেখানে ভালো সুযোগ সৃষ্টি হলো। আমি সবসময় দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সহযোগিতা, যোগাযোগ এবং মতবিনিময়, অভিজ্ঞতা বিনিময়ের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকি। কারণ সার্বিকভাবে আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বন্ধুত্বটা গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এখানে বলব সরকার গঠনের পর এইবার প্রথম বিদেশ সফর করলাম থাইল্যান্ডে। বলতে গেলে ঘরের কাছের পড়শী দেশ। আমি সবসময় বন্ধুত্বকে গুরুত্ব দেই। থাইল্যান্ড কিন্তু খাদ্য, ফসল, ফল উৎপাদনে অনেক গবেষণা ও উৎকর্ষতা আছে। এইসব ক্ষেত্রে মতবিনিময় করছি। গবেষণা কিভাবে দুইদেশ ভাগাভাগি করতে পারি, অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করতে পারি।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের অফিশিয়াল পাসপোর্টধারীরা সহজে সেখানে যেতে পারবে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সহজে পণ্য রফতানি-আমদানি সহজভাবে করতে পারবো। ব্যবসা-বাণিজ্য, থাইল্যান্ড যেহেতু পর্যটনক্ষেত্রে অগ্রগামী সেই অভিজ্ঞতাটাও আমরা নিতে পারি। সেখানে বিনিয়োগ করতে পারবে, আমরা জায়গাও দিতে পারবো। পাশাপাশি আমাদের যে ৮০ মাইল লম্বা বালুকাময় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত রয়েছে, সেখানেও বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানিয়েছি। সেখানে জায়গা চাইলে আমরা দেবো। এই সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অভিজ্ঞতা বিনিময়ের ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যা ভবিষ্যতে আর্থসামাজিক উন্নয়নে কাজে লাগবে। থাইল্যান্ড আসিয়ানভুক্ত দেশ এবং এখন বিমসটেকের সভাপতি। বিমসটেকটা আমরাই প্রথম প্রতিষ্ঠা করেছি। আমি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসাবে আছি। আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতাটা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।’
তিনি বলেন, ‘করোনা পরবর্তী ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হওয়া দরকার এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে মতবিনিময় করে, অভিজ্ঞতা বিনিময় করে দেশের মানুষের কল্যাণ করতে পারি সেটাকে আমি গুরুত্ব দিয়েছি। এটাই বড় প্রাপ্তি বলে মনে করি।’
শেখ হাসিনা বলেছেন, অবৈধ মজুতদারদের বিষয়টা সরকারের নজরে আছে৷ কিছু আছে চক্রান্ত, কিছু আছে অধিক মুনাফার লোভ৷ নির্দিষ্ট বেতনে চলা মানুষ কষ্টে আছে এটা ঠিক৷ তবে পণ্যের দাম একটু বাড়লেই, অনেক বড় করে গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়, এটা ঠিক না৷ কেননা, কমবেশি বিশ্বের সব দেশেই এখন মুদ্রাস্ফীতি চলছে৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। বৈশাখ মাসে দেশে গরম পড়া নতুন কিছু নয়৷ তবে সবাইকে সাবধান হতে অনুরোধ করছি৷ কেননা, হিটস্ট্রোক বাড়ছে৷ প্রকৃতির সঙ্গে তো কিছু বলার নেই৷ দেশে বন্যা হতে পারে৷ সেসব মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে৷
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনের আমন্ত্রণে গত ২৪ এপ্রিল বিকেলে ব্যাংককে পৌঁছান শেখ হাসিনা। ডন মুয়াং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫২ বছরে থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান পর্যায়ের প্রথম সফর ছিল এটি। সফরের দ্বিতীয় দিন ২৫ এপ্রিল জাতিসংঘের এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনইএসসিএপি) ৮০তম অধিবেশনে যোগ দেন বাংলাদেশ সরকারপ্রধান। এই সফরে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশন এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের নির্বাহী সচিব আরমিডা সালসিয়াহ আলিশাবানা সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।