গাজীপুরে হারের পর ভোটের নানা হিসাব-নিকাশ উড়িয়ে দিয়ে দক্ষিণের দুই সিটিতেই জয়ের দেখা পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। গাজীপুর হাতছাড়া হলেও দক্ষিণবঙ্গ নিজেদের দখলেই রেখেছে নৌকা।
খুলনায় আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক এবং বরিশালে নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত বড় ব্যবধানে জয় পেয়েছেন।
সকাল ৮টা থেকে দুই সিটিতে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। একটানা চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। রাতেই বেসরকারিভাবে জানা যায় কারা জয় পেয়েছেন। ভোটে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ধীরগতি, প্রার্থী-সমর্থকদের ধাক্কাধাক্কি, পুলিশ প্রশাসনের লাঠিচার্জ ও রক্তাক্ত হওয়ার মতো দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হয় স্থানীয় সরকারের এই ভোট। তবে দুই সিটিতেই হাতপাখা ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থীরা অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্র থেকে তাদের এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে। হাতপাখায় ভোট দিলে নৌকায় যায়, কিন্তু এসব অভিযোগ রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিতভাবে জমা দেয়নি দলটি। তবে বরিশালে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় উত্তাপ ছড়ায়।
রাজপথের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এই ভোটে অংশ না নিলেও দুই সিটিতেই উত্তাপ ছড়িয়েছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দুই সিটিতে গড়ে ৪৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়বে বলে ধারণা আউয়াল কমিশনের। তার মানে অর্ধেক ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে দূরে ছিলেন।
বরিশাল-খুলনা সিটি করপোরেশনসহ দুই পৌরসভায় আনন্দমুখর পরিবেশে ভোট হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন ভোট আয়োজনকারী সংস্থাটির প্রধান সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। বরিশালের বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে গোপন কক্ষে ডাকাতের উপস্থিতি দেখা গেলেও ঢাকায় নির্বাচন কমিশনে সিসিটিভি ক্যামেরায় এ ধরনের কোনো ঘটনা দেখা যায়নি বলে জানানো হয়।
সোমবার দক্ষিণবঙ্গের খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ভোট গ্রহণ হয়। এদিন সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা ভোট চলে। কেন্দ্র পাহারায় মোতায়েন ১৬ থেকে ১৭ জনের ফোর্স। মাঠে নির্বাচনী আচরণ প্রতিপালনে নিয়োজিত ছিলেন নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট। এ ছাড়া ছিল ইসির নিজস্ব পর্যবেক্ষক টিমও। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। রাজধানী ঢাকার নির্বাচন ভবনে ভোট গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছেন নির্বাচন কমিশনাররাও।
ইসির মিলনায়তনে স্থাপিত ২৩টি ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডের মাধ্যমে একই সঙ্গে ২ হাজার ৮৭১টি ভোটকক্ষ পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। প্রতি ডিসপ্লে ১০ সেকেন্ড পরপর অটো রোটেড করা হচ্ছে, যার ফলে ৪৫৮টি কেন্দ্রেরই ভোট গ্রহণ পর্যবেক্ষণ করেছিল সাংবিধানিক এ সংস্থা।
অবশ্য খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখনো রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তারা লিখিতভাবে কিছু বলেননি। সন্ধ্যায় বরিশাল নগরীর চাঁদমারী কমপ্লেক্সে ফলাফল প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন দলের আমির সৈয়দ রেজাউল করিম। এ ছাড়া সামনে আগামী ২১ জুন সিলেট ও রাজশাহী সিটি নির্বাচনের ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে দলটি।
গাজীপুরে নৌকার পরাজয়ের পর ভোটের মাঠের হিসাব-নিকাশ বদলে যাওয়ার যে ধারণা করা হয়েছিল, তা সত্য প্রমাণিত হওয়ার সুযোগ দেননি দুই সিটির নৌকার মাঝি। বরং বিপুল ব্যবধানে তাদের জয় অনেকটা নির্ভার রাখবে ক্ষমতাসীনদের।
তৃতীয়বারের মতো মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক
খুলনা সিটি করপোরেশনে (কেসিসি) তৃতীয়বারের মতো মেয়রের আসনে বসতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী তালুকদার আব্দুল খালেক। এ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ২৮৯ কেন্দ্রের সবগুলোর ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। ঘোষিত ফল অনুযায়ী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
সোমবার রাত ৮টা ৪৮ মিনিটে খুলনা শিল্পকলার মিলনায়তনে কেসিসি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দিন এ ফলাফল ঘোষণা করেন। এ নির্বাচনে ৪৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ ভোট পড়েছে।
ঘোষিত ফল অনুযায়ী, তালুকদার আবদুল খালেক নৌকা প্রতীকে মোট ১ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মো. আব্দুল আউয়াল হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৬০ হাজার ৬৪ ভোট।
এ পদে অন্যান্য প্রার্থীর মধ্যে জাতীয় পার্টি থেকে লাঙ্গল প্রতীকে মো. শফিকুল ইসলাম মধু পেয়েছেন ১৮ হাজার ৭টি ভোট, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে এস এম শফিকুর রহমান পেয়েছেন ১৭ হাজার ২১৮টি ভোট এবং জাকের পার্টি থেকে গোলাপ ফুল প্রতীকে এস এম সাব্বির হোসেন ছয় হাজার ৯৬টি ভোট পেয়েছেন।
এ নির্বাচনে পাঁচ মেয়র প্রার্থীর পাশাপাশি ৩১টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৩৬ জন ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে মহিলা কাউন্সিলর পদে ৩৯ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। নগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে ২৮৯ ভোটকেন্দ্রের এক হাজার ৭৩২টি ভোটকক্ষে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোটকেন্দ্র সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের জন্য মোট দুই হাজার ৩১০টি সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছিল।
শঙ্কা হটিয়ে মেয়র খায়ের
বেসরকারিভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ (খোকন সেরনিয়াবাত)। বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয় পেয়েছেন তিনি।
১২৬টি কেন্দ্রের বেসরকারি ফলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ পেয়েছেন ৮৭ হাজার ৮০৮ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী মুফতি সৈয়দ ফয়জুল করীম হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ৩৩ হাজার ৮২৮ ভোট।
গতকাল সোমবার রাত ৯টার দিকে জেলা শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়ামে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করেন সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির।
এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বরিশাল সিটি করপোরেশনে ২ লাখ ৭৬ হাজার ২৯৪ ভোটার। এর মধ্যে ভোট পড়েছে এক লাখ ৪১ হাজার ৭৫৬টি। হিসাবে অর্ধলাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন নৌকার প্রার্থী। শতকরা ভোট পড়েছে ৫১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।’
এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেয়ার অবস্থান থেকে বিএনপি বরিশাল সিটি করপোরেশনের ভোটেও আসেনি।
নির্বাচনে মেয়র পদে খোকন সেরনিয়াবাত ও ফয়জুল করীম ছাড়াও জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস, জাকের পার্টির গোলাপ ফুল প্রতীকের প্রার্থী মিজানুর রহমান বাচ্চু, টেবিল ঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান রুপন, হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আসাদুজ্জামান ও হরিণ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আলী হোসেন হাওলাদারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।
এছাড়া এই সিটি নির্বাচনে ১১৮ জন কাউন্সিলর প্রার্থী ও ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪২ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।